রেজাউল করিম খান

  ২৩ জুন, ২০১৮

বিশ্লেষণ

সময়ের কাঠগড়ায় আমাদের রাজনীতি

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে নেওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, তিনি কারাগারে গেলে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকরা দলে দলে রাস্তায় নেমে আসবেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে, সরকার সমঝোতা করতে বাধ্য হবে। কিন্তু না, তা হয়নি। অতিশয় শান্তিপূর্ণ কিছু প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। কোনো সহিংসতা হয়নি। আন্দোলন হয়েছে নামমাত্র। নেতাকর্মীরা অপরিসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। তা দেখে গান্ধীবাদীরাও লজ্জা পেয়েছেন। কিন্তু নির্বাসিত হয়েছে রাজনীতি। অথবা বলা যায়, এর আগেই বিএনপির রাজনীতি বন্দি হয়ে গেছে। যেকোনো দলের নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকে। থাকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এ ধরনের দলের প্রধান উদ্দেশ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। দেশ ও জনগণের মঙ্গলের বিষয়টি কেবল থাকে তাদের ইশতেহারে। ক্ষমতায় গেলে পাতা উল্টে দেখারও সময় পাওয়া যায় না। এমনি ধারার একটি রাজনৈকি দল বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন এখন কারাগারে। দ-প্রাপ্ত হওয়ায় তারই ছেলে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত করা হয়েছে। তিনিও সাজাপ্রাপ্ত। খালেদা জিয়া সম্ভবত অন্য কারো ওপর ভরসা রাখতে পারেননি। অথবা দলের ভাঙনরোধে এমন সিদ্ধান্ত।

দেশে এখন তেমন কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। থাকার কথাও না। সত্যিকার অর্থে কর্মক্ষম রাজনৈতিক দলই নেই তো তৎপরতা থাকবে কীভাবে? আছে সরকারি দল ও তাদের জোট। তারাই দেশের মালিক। প্রজাসাধারণ কেবল কৃপার পাত্র। গতর খেটে কামাই, খায়-দায় আর ঘুমায়। রাজনীতি বোঝে না, বুঝতেও চায় না। আওয়ামী লীগ-বিএনপির খবর শোনে, টেলিভিশনে হাসিনা-খালেদার ছবিও দেখে। কথা হয় হাটে-বাজারে, নামাজ শেষে, হাঁটার সময়, চায়ের দোকানে, খেত-খামারে, কলে-কারখানায়। সাধারণ মানুষ জানতে চায়, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে কেন? চাকরির খবর কী? সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন দ্বিগুণ হয়, অন্যদের হয় না কেন? প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কীভাবে? যানজট কমে না কেন? সড়ক দুর্ঘটনায় আর কত মৃত্যু হবে? চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে হয় কেন? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন এখন মানুষের মনে। কিন্তু জবাব নেই। এসব ব্যাপারে সরকার সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ায় না। বিরোধী দল, বিএনপি বা অন্য দলগুলো কথা বলে না, আন্দোলন করে না, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে না। সবাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। কিসের অপেক্ষা, তা স্পষ্ট নয়।

কিছুদিন থেকেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও চিকিৎসা নিয়ে দুই পক্ষে কথা হচ্ছে। উঠছে বিধিবিধানের কথাও। সরকার কারা হাসপাতাল বা সরকারি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করাতে চায়। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষের কোনো মেডিকেল বোর্ড নেই, নেই সেই ধরনের চিকিৎসক দলের কোনো বক্তব্য। বিএনপি নেতারা প্রশ্ন তুলছেন, এমন কোনো বিধি আছে, খালেদা জিয়াকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো যাবে না? কারাবিধিতে সুচিকিৎসার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে খালেদা জিয়া কেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে যাবেন না, তাও স্পষ্ট করে বলছেন না। অথচ বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে, তিনি বেশ অসুস্থ। নানা রোগে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁটুর ব্যথা প্রভৃতি নিয়ে শয্যাশায়ী। তবে সবচেয়ে বড় কথা তিনি নিঃসঙ্গ এবং মানসিক চাপে অস্থির। তার জীবনের প্রায় সবটুকুই কেটেছে অত্যন্ত আরাম আয়েশে। নিকটজনের সান্নিধ্য না পেয়ে তিনি এখন অসহায়। তিনি ভাবতেই পারছেন না, তার কথা এখন কেউ শোনে না, মানে না। এমতাবস্থায় তিনি অসুস্থ হতেই পারেন। তবে তিনি এখনো সজ্ঞানে আছেন বলে ধারণা করা যায়। আর তাই চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত মানছেন না। কিন্তু জ্ঞান হারালে সরকার হয়তো বসে থাকবে না। তাকে সরকারি হাসপাতালেই পাঠানো হবে। তখন হয়তো সেখানে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাকশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারেন, পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে পারেন, জরুরি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে, আইসিইউতে রাখা হতে পারে, কোমায় চলে যেতে পারেন। অবশেষে তিনি মারাও যেতে পারেন। অনেকেরই এমন হয়। তবে আশা করছি, খালেদা খালেদা জিয়ার এমন কিছুই হবে না। এর মধ্যেও রয়েছে ঘোরতর রাজনীতি।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা, বিচার আয়োজন, সাজা প্রদান, পুরনো কারাগারে রাখা, জামিনের নথি নিয়ে টানাহেঁচড়া, উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত প্রভৃতি দেখে প্রতীয়মান হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো চাচ্ছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত খালেদা জিয়া কারাগারেই থাকুন। আইনি ব্যবস্থা সেভাবেই নেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতেও আইনের বাইরে কিছুই করা হবে না। একটি বিষয় পরিষ্কার, সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে কারো ট্যাঁ-ফুঁ করার জো নেই। বিএনপি নেতারা অবশ্য অনুগত প্রজার মতো সরকারের কাছে এসব বিষয়ে প্রতিদিনই নালিশ জানাচ্ছেন। কথিকা পাঠের মতো প্রায় একই কথা শুনছি আমরা দীর্ঘদিন থেকে। টিভি ক্যামেরা উপস্থিত না হলে আর সংবাদমাধ্যমে ওই খবর প্রচারিত না হলে, কথিকা পাঠও বন্ধ হয়ে যেত। যেমন হয়েছে রাজপথের আন্দোলন। অবশ্য এটি হয়েছে ভিন্ন কারণে। প্রচলিত সুবিধাপ্রাপ্তির রাজনীতি করার পেছনে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে। কেউ নেতা হয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়, কেউ চায় ক্ষমতার অংশীদার হতে, কেউ চায় পদ-পদবি, আবার অনেকে ‘আমার সরকার ক্ষমতায়’ এইটুকু বলেই তৃপ্তি বোধ করে। কারো কারো বাতিক আছে ক্ষমতা প্রদর্শনে। তবে প্রায় সবারই মূল উদ্দেশ্য আর্থিক সুবিধা গ্রহণ। অবশ্য সেই সুবিধা সরকার তাদের দিয়ে থাকে। এ কারণে নেতাকর্মীরা উদ্বুদ্ধ হয়, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে, সংগঠনের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করে ও সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করে। কিন্তু এসব কর্মকা- এখন আর বিএনপির অনুকূলে নেই। তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করলে আওয়ামী লীগ ও তার জোট সরকার নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। বিএনপি শুধু নির্বাচন বর্জনই করেনি, প্রতিহতেরও ঘোষণা দেয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর হাতে সব আন্দোলনের কর্মসূচি দমন করতে সক্ষম হন। নির্বাচন প্রতিহতের আন্দোলন ব্যর্থ হয়। মামলা-হামলায় বিএনপি নেতাকর্মীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের দলে দলে কারাগারে পাঠানো হয়। অনেকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। গুম-খুনও হয় কেউ কেউ। সবার মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। শীর্ষ নেতারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। এমনকি, খালেদা খালেদা জিয়াও কর্মসূচির ডাক দিয়ে গাড়ির পাদানি থেকে নেমে রাস্তায় পা দেননি। ধীরে ধীরে রাজপথ থেকে রাজনীতি নির্বাসিত হয়ে যায়।

রাজপথের রাজনীতি নেই তো কী হয়েছে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আছে না! তারাই এখন দেশের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন হচ্ছে টকশো, আলোচনা বৈঠক, সংবাদ পর্যালোচনা প্রভৃতি টিভি অনুষ্ঠান। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার উচ্চস্তরের নেতৃস্থানীয় মানুষ এসব অনুষ্ঠানে কথা বলেন, মতামত দেন। আলোচনা হয় নানা বিষয় নিয়ে। এর মধ্যে দেশ, গণতন্ত্র, নির্বাচন, রাজনীতিই বেশি থাকে। সাধারণ মানুষ রাত জেগে সেসব আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া, বাক্বিত-া শোনেন। তবে দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা ক্রমেই কমছে বলে ধারণা করা যায়। দেশে যেহেতু দৃশ্যমান রাজনীতি নেই, সেহেতু রাজনীতির আলোচনা তাদের কাছে অর্থহীন মনে হয়। প্রধান দুই দলের বক্তারা একে অপরের অতীতের অপকর্মের ইতিহাস টেনে নিজেদের কর্মকে জায়েজের চেষ্টা করেন। তাদের মতামত ‘নিজস্ব’ বা ব্যক্তিগত। দলের নয়। নীতিনির্ধারক হিসেবে দলের সিদ্ধান্ত বা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন একমাত্র দলীয় প্রধান। বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রী এবং সভাপতির পরে শীর্ষ নেতারা যা বলেন তা কেবল চর্বিতচর্বণই নয়, বিরক্তিকরও বটে। এসব আলোচনা অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে বাম-কমিউনিস্ট দলের নেতারাও উপস্থিত থাকেন। একসময় তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন। কাঁপিয়েছেন রাজপথ। এখন টকশো আর সেমিনারে বক্তৃতা দেন। তবে এসবও রাজনীতির অংশ। জনগণকে বোকা বানানোর রাজনীতি। কিন্তু জনগণ কি সত্যিই অত বোকা?

জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচনের দিনক্ষণ এগিয়ে আসছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। দেশে এ মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক সংকট আছে বলে আওয়ামী লীগ মনে করে না। তাদের প্রয়োজনে ও অনুকূলে সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছে। সেই বিধি অনুযায়ী এবার সংসদ ভাঙা যাবে না। সদস্যরা পদে বহাল থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। আর সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের সদস্যদের নিয়ে ছোট আকারের মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। তারা দৈনন্দিন রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। এসবের মধ্যে বিএনপির অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় বিএনপি খুবই কোণঠাসা হয়ে আছে। সময় কম। আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। বিএনপি নেতারা বুঝতে পেরেছেন, নালিশ জানিয়ে, আলোচনা বা তদবির করে দাবি আদায় করা যাবে না। এর পরও তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কেন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করা হয়, কেন নির্বাচন প্রতিহতের সিদ্ধান্ত হয়, কেন জামায়াতে ইসলামীকে জোট থেকে বের করা হয় না, কেন জনগণের সমস্যা বাদ দিয়ে মাতা-পুত্রের জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়, কেন খালেদার পরিবর্তে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন করা হয়, কেন গণস্বাক্ষর সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist