রেজাউল করিম খান

  ১৮ জুন, ২০১৮

আষাঢ়ের ঈদ

এবার ঈদ হয়েছে আষাঢ় মাসে। চলতি বছর রমজানের শুরু থেকেই জ্যৈষ্ঠ মাসজুড়েই গরম ছিল। বৃষ্টিও হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। রোদ আর ঝড়-বৃষ্টির ভেতরেই কেটে গেল রোজার মাস। বৈরী আবহাওয়ার কারণে বেশ কিছুটা ক্ষতি হয়েছে ফসলের। ঈদের আগে কৃষক তার স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা, ভাই-বোন সবারই চাহিদা পূরণ করে উঠতি ফসল বিক্রির টাকা দিয়ে। ফসলের ক্ষতি হওয়ায় এবার ঈদের খরচে টান পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সেই তুলনায় দিনমজুরদের অবস্থা কিছুটা ভালো। স্বামীর রোজগার ছাড়াও স্ত্রী পালন করেছে ছাগল-মুরগি-হাঁস। এ ছাড়া অনেকেই এনজিও ঋণ নিয়ে গাভী পালন করেছে। করছে ক্ষুদ্র ব্যবসাও। আয়-রোজগার যাই হোক, বাঙালি উৎসবের আগে কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব মেলাতে বসে না। পালন করে আবেগ দিয়ে। এখানে স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা প্রাধান্য পায়। ঋণ করে হলেও প্রিয়জনের প্রয়োজন মেটাতে কার্পণ্য করে না। বাঙালি মুসলমানের কাছে ঈদ শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, সামাজিক উৎসবও বটে। ছোট-বড় সবাই সেই উৎসবে সাড়ম্বরে অংশগ্রহণ করে। সব আনন্দ ভাগ করে সবাই।

ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গী হয়ে আসে বজ্রপাত। এবারও ওরা এসেছে, এসেছে নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগেই। বজ্রপাতে ঈদের আগেই দুই শতাধিক মানুষ মারা গেছে। গত ২৯ এপ্রিল এক দিনেই সারা দেশে মারা যায় ১৭ জন। আহত হয় ১৪ জন। গত বছর মারা গেছে ৩০১ জন। বজ্রপাতে মৃত্যু অতিশয় মর্মান্তিক। এভাবে কেউ মারা গেলে ক্ষতিপূরণের কোনো সুযোগ নেই। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু হলে তো অন্যরা পথে বসে। বজ্রপাতে সাধারণত কোনো ধনী মানুষের মৃত্যু হয় না। বলাই বাহুল্য, এবার বজ্রপাতে নিহত ও আহত মানুষের পরিবারে ঈদের আনন্দ থাকবে না।

বুয়েটের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম জানান, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। বজ্রপাতের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। তাপমাত্রা, বাতাসে সিসার পরিমাণ, মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং জনজীবনে ধাতব পদার্থ ব্যবহারের আধিক্যের কারণে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ ছাড়া বন ও জলাভূমি কমে যাওয়াও বজ্রপাতের অন্যতম কারণ। বজ্রপাতের মতো সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুও দুঃখজনক। আর এ মৃত্যু ঈদযাত্রায় বেশি হয়। নিকটজনের সঙ্গে ঈদ করার জন্য বাড়ি যাওয়া আবার কর্মস্থলে ফিরে আসার পথে জীবন দিতে হয় অনেককেই। তবু এ যাত্রার বিরাম নেই। পরিসংখ্যান ছাড়াই বলা যায়, গত এক সপ্তাহে সড়ক দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর মারা গেছে ৭ হাজার ৯০৮ জন। ৩ হাজার ৩৪৯টি দুর্ঘটনায় এ মৃত্যু হয়। নিহতের মধ্যে ৪ হাজার ৩২৭ জন পুরুষ ও ১ হাজার ৩১৮ জন মহিলা।

এবার ঈদের আগে ঘোষণা করা হয়েছে চলতি অর্থবছরের বাজেট। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার সংসদে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে বাজেট নিয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে না। তারা দেখছেন বাজারে কোন পণ্যের দাম বাড়ল বা কমল। একসময় সংসদে বাজেট পেশ করার পরপরই সরকারি ও বিরোধী দল রাস্তায় নামত মিছিল নিয়ে। একদল বলত, এটি দেশ ও জনগণের কল্যাণে উন্নয়নের বাজেট। অন্য দলের স্লোগান ছিল, গরিব মারার বাজেট মানি না, মানব না। এখন আর তেমনটি দেখা যায় না। বিরোধী পক্ষকে রাস্তায় নামতেই দেওয়া হয় না। অথবা বলা যায় নামার যোগ্যতা তারা হারিয়েছে। এখন আলোচনা হয় ঘরের ভেতর, গোলটেবিল বৈঠকে, সেমিনারে, সংবাদ সম্মেলনে, টেলিভিশনের টক শোতে। দেওয়া হয় প্রেস বিজ্ঞপ্তি।

তো এবারের বাজেট সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর বলেছেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটকে জনতুষ্টিমূলক বলতে পারি। আর নির্বাচনী বছরে এটা কাম্যও বটে। জনতুষ্টির একটি উদাহরণ : বাজেটে মাদরাসা ও স্কুলের সংস্কারে ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটা মোট বাজেটের ৪ শতাংশ। এই বরাদ্দ মূলত এমপিদের জন্য। এটা এক ধরনের উপঢৌকন। এখানে তদারকির বিষয়টি এমপিদের হাতে। আমাদের দেশে এ ধরনের প্রকল্পে কী হয়, তা আমরা ভালো করে জানি।’ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, মন্ত্রণালয়গুলো বাজেট গৃহীত হওয়ার পরদিন থেকে খরচ করতে পারবে। অর্থাৎ আগের মতো প্রকল্প গ্রহণের পর অর্থছাড়ের জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।

এবারের ঈদে বিনোদনের ব্যবস্থা বরাবরের মতোই। হলে মুক্তি পাচ্ছে কয়েকটি ছবি। যদিও দেশের অধিকাংশ সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে শুরু হয়েছে অন্য ব্যবসা। অবশিষ্ট অনেকগুলো বন্ধ, যা আছে তাও ভাঙা চেয়ার, গরম আর ছারপোকার কারণে ব্যবহারের অনুপযোগী। তবে রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি শহরে আধুনিক সিনেমা হলে ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে টিভি চ্যানেলগুলোয়ও প্রচারিত হবে বেশ কিছু সিনেমা। ঈদের জন্য তৈরি হয়েছে অনেকগুলো নাটক ও টেলিফিল্ম, যা কয়েকদিন ধরে দেখানো হবে টিভি চ্যানেলগুলোয়।

আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় এবার বাইরে বেড়ানোর পরিকল্পনা অনেকেরই নেই। ফলে টেলিভিশনই হবে বিনোদনের অন্যতম প্রধান উপকরণ। টেলিভিশনেই থাকছে জনপ্রিয় শিল্পীদের গান। প্রকাশিত হচ্ছে গানের অ্যালবাম। অনেকে এখন বেশি সময় কাটান ফেসবুক দেখে। শিশু থেকে অশীতিপর প্রায় সবাই ক্রমেই ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। অবশ্য শিশুদের কাছে কার্টুনই বেশি প্রিয়। সংবাদপত্রগুলো বের করেছে ঈদসংখ্যা। এসেছে আরো কিছু ম্যাগাজিন। কেউ কেউ বই পড়তে ভালোবাসেন। আছে নানা বিষয়ের মজার সব বই। তবে বই, সাময়িকী ও সংবাদপত্র পাঠকের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে।

এবারের ঈদে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। সারা দেশের গ্রাম-শহরে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের উদ্যোগে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে ঈদের শুভেচ্ছা জানানো তাদেরই ব্যানার, পোস্টার শোভা পাচ্ছে। দুস্থ, অসচ্ছল মানুষের মধ্যে ঈদের উপহারসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। ক্যাডাররাও বঞ্চিত হচ্ছে না। নির্বাচনের বছর বলে কথা! ইফতার পার্টির মঞ্চে বিএনপিকেও দেখা যাচ্ছে। তবে বিশেষ নেতাদের উপস্থিতি কম। অনেক নেতা আছেন কারাগারে, অনেকে বাড়িছাড়া। সীমিত হলেও আছে জাতীয় পার্টি।

এবার ঈদের আগে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান, যা এখনো চলছে। গত ৩ মে র‌্যাবের ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে র‌্যাব কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে র‌্যাব ও পুলিশ কোমর বেঁধে অভিযানে নামে। সঙ্গে যোগ দেয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। অভিযান শুরু হয় ১৫ মে থেকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘মাদক সমূলে নির্মূলে মাদক চোরাচালানের মূল হোতাদের তালিকা করা হচ্ছে। চিহ্নিত করা হচ্ছে মাদক চোরাচালানের প্রবেশপথ।’ গত ১২ মে কিশোরগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যুবসমাজকে, মেধাবীদের রক্ষা করতে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমন অভিযানের মতো মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। আর সেই নির্দেশনা অনুযায়ী মাদক নির্মূলে অভিযান চালানো হচ্ছে।’

এর আগেও অভিযান হয়েছে। তবে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এবার ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। বন্দুকযুদ্ধের পর যে গল্প বলা হয়, তা কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। নিহত অনেক পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের বিভিন্ন স্থান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মাদকবিরোধী অভিযানে গত চার সপ্তাহে সারা দেশে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে দেড়শ জনেরও বেশি মানুষ। গ্রেফতার হয়েছে চার সহস্রাধিক। সাজা দেওয়া হয়েছে প্রায় চার হাজার জনের। এদের অধিকাংশই মাদক সেবনকারী।

পুলিশের কেউ কেউ বলছেন, এদের ধরলে বা সাজা দিলে ভয় পেয়ে তারা নেশা ছাড়বে। প্রায় সব ধরনের মাদকদ্রব্য এখন সহজলভ্য বাংলাদেশে। এর মধ্যে আছে মদ, গাঁজা, চরস, ভাং, চুয়ানি, হেরোইন, ফেনসিডিল, এলএসডি, মরফিন, প্যাথেড্রিন এবং ইয়াবা। বর্তমানে হেরোইন ও ফেনসিডিলের চেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে ইয়াবা। মাদকের করুণ পরিণতি লাখ লাখ পরিবারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। তবে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিনাবিচারে মানুষ হত্যার প্রশ্নে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক উঠেছে। এবার ঈদের আগে এসব নিহত মানুষের পরিবারের সদস্যদের কাছে আমাদের কি কোনো জবাব আছে!

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঈদ,আষাঢ়,ঈদ যাত্রা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist