তাজিনের অসহায় মৃত্যুর নেপথ্যে
বাংলাদেশের বিনোদন জগতে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তাজিন আহমেদ। ভদ্র-পরিচ্ছন্ন এই অভিনেত্রী বহু মানুষের হৃদয়জয় করেছিলেন।
মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় রাজধানীর উত্তরার বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। ওই সময় তার পাশে আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না।
বাসায় থাকা নিজের মেকআপ আর্টিস্টই অচেতন তাজিনকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে আইসিউতে থাকা অবস্থায় বিকাল ৪টা ৩৫ মিনিটে মারা যান ৪৩ বছরের এ অভিনেত্রী।
তাজিনের এমন অসহায় মৃত্যু নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। যার জবাব খুঁজতে গিয়ে ভুল তথ্যের গুজবে ছড়িয়েছে বিভ্রান্তি।
মৃত্যুর সময় স্বজন-পরিজনকে পাশে না পাওয়া তাজিনের কোনো কোনো সহকর্মী আফসোস করে বলেছেন, ‘খারাপ লাগল এই ভেবে যে, মৃত্যুর সময় তাজিনের পরিবারের কেউ পাশে ছিলেন না।’
মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত তাজিনের পরিবারের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি বলেও জানিয়েছিলেন অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব নাসিম।
এদিকে পরম স্বজনদের মধ্যে বেঁচে থাকা তাজিনের মা দিলারা জলি গাজীপুরের একটি বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন বলে গুজব ছড়ালে সামাজিকমাধ্যমে তাজিন সম্পর্কে অনেকে কটূক্তিও করেন।
যদিও সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে তাজিন জানিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন মা অন্তপ্রাণ। এমনকি ফেসবুকে শেষ স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছিলেন ‘মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার।’
তারপর বুধবার সকালে স্পষ্টভাবে জানা গেল, ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর এতিম তাজিন আহমেদ যার হাত ধরে বড় হয়েছেন সেই একমাত্র স্বজন মা দিলারা জলি কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
তাজিন আহমেদ নিয়মিতই গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে মাকে দেখে আসতেন। আজ সকালে মাকে দেখাতে তাজিনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়।
কারাসূত্র জানিয়েছে, কারাফটকে তাজিনের লাশ রাখার পর ভেতরে মা দিলারা জলিকে খবর দিয়ে আনা হয়। মেয়ের লাশ দেখে তিনি কেঁদে ফেলেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ লাশের পাশে বসে থাকেন।
এরপর তাজিনের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স কারাগার থেকে বেরিয়ে গেলে তার মাকে কারাগারের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরে দুপুরে গুলশানের আজাদ মসজিদে তাজিনের জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে বাবা কামাল উদ্দিন আহমেদের কবরে তিনি চিরশয্যায় শায়িত হন।
১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন তাজিন আহমেদ। ছোটবেলাতে তার বাবা কামাল উদ্দিন আহমেদ মারা যান। এরপর তাজিনকে নিয়ে পাবনায় বাবার বাড়িতে চলে যান বিধবা দিলারা জলি।
সেখানে শৈশব কাটানোর পর কৈশোর রাজধানীর আদাবরে নানার বাড়িতে চলে আসেন তাজিন। পরে ইডেন কলেজে পড়াশোনা করেন। এখানে ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর করেন তিনি।
মায়ের হাত ধরেই অভিনয়ে আসেন তাজিন আহমেদ। মা দিলারা জলির প্রোডাকশন হাউস ছিল। তিনি দীর্ঘদিন থিয়েটারেও অভিনয় করেছেন। ‘নাট্যজন’ থিয়েটারের হয়ে বেশকিছু নাটকে তিনি অভিনয় করেন। এরপর ‘আরণ্যক’ নাট্যদলের হয়ে ‘ময়ূর সিংহাসন’ নাটকে কাজ করেছিলেন। এতে তিনি বলাকা চরিত্রে অভিনয় করেন। তার সর্বশেষ অভিনীত মঞ্চনাটক এটি।
‘শেষ দেখা শেষ নয়’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাজিনের টেলিভিশনে অভিনয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। নাটকটি ১৯৯৬ সালে বিটিভিতে প্রচার হয়। এরপর তিনি অসংখ্য নাটক-টেলিছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘নীলচুড়ি’তে অভিনয় করেও বেশ আলোচিত হন। তার সর্বশেষ অভিনীত ধারাবাহিক নাটক ‘বিদেশি পাড়া’।
অভিনয়ের বাইরে লেখালেখির কাজেও যুক্ত ছিলেন তাজিন। লিখেছেন একাধিক নাটক। আর নিয়মিত মিডিয়ায় সময় দিতে না পারলেও উপস্থাপনায় ছিলেন বেশ দাপুটে। এনটিভিতে প্রচারিত ‘টিফিনের ফাঁকে’ অনুষ্ঠানে টানা ১০ বছর উপস্থাপনা করেন তিনি। ৭১ টিভিতেও ‘একাত্তরের সকালে’ হাজির হয়েছেন তিনি।
তাজিন আহমেদ রাজনৈতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)’-এ যোগ দিয়েছিলেন। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির বিভাগীয় সম্পাদক (সাংস্কৃতিক) পদে দায়িত্বপালন করেছেন তিনি।
তবে জীবনের নানা টানাপোড়েনের কারণে আস্তে আস্তে মিডিয়া ছেড়ে নিবৃত্ত জীবনে চলে যান তাজিন। প্রথম ধাক্কা আসে দাম্পত্য জীবনে। ভালোবেসে নাট্য নির্মাতা এজাজ মুন্নাকে বিয়ে করলেও সেই সংসার বেশিদিন টেকেনি। এরপর সঙ্গীতশিল্পী ও পরিচালক রুমি রহমানের সঙ্গে সংসারজীবনে আবদ্ধ হলেও আলাদা থাকেন তারা।
পিডিএসও/রিহাব