সম্পাদকীয়
প্রবাসে অনিরাপদ নারীশ্রমিক
নারী জাতিকে সম্মান না জানিয়ে কোনো জাতিরাষ্ট্র উন্নতির শিখরে উঠেছে—এমন নজির খুঁজে পাওয়া ভার। তারপরও নারীসমাজ বিশ্বের সর্বত্রই নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়েই চলেছে। শতসহস্র কোটি বছরে সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে অনেক। কিন্তু দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার তিল পরিমাণও কমেনি। বরং নির্দ্বিধায় বলা যায়, ক্ষেত্রবিশেষ এর মাত্রা বেড়েছে। সভ্যতার স্নো-পাউডার আর ফেসমেকআপের আড়ালে ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে নির্যাতনের রক্তাক্ত দৃশ্যাবলি। প্রবাসী শ্রমিকদের দিকে তাকালে এর কিছুটা সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে নারীশ্রমিক।
সৌদি আরব থেকে দলে দলে ফিরে আসছেন নারীশ্রমিক। তাদের অধিকাংশই গৃহকর্মী। প্রবাসে অমানবিক নির্যাতনের শিকার তারা। অনেক নারীকেই নিয়োগকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। গত শনি ও রোববার—এ দুদিনেই সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা নির্যাতিত নারীশ্রমিকের সংখ্যা ৮৪। অন্য এক সূত্র মতে, গত ৮ থেকে ১৩ জানুয়ারির মধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে একই রাষ্ট্র থেকে ফিরেছেন ৩২৪ নারী। তারা সবাই গৃহকর্মী। পৃথিবীর কোথাও যেন তাদের নিরাপত্তা নেই। দেশে থেকেও তারা অর্থনৈতিক নিরাপত্তাবলয়ের ভেতরে থাকতে পারেননি। আর সেই নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সবকিছু পেছনে ফেলে তাদের এই প্রবাসযাত্রা।
বিদেশ যাওয়ার আগে তারা হয়তো ভেবেছিলেন, এবার অর্থনৈতিক নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে আসা যাবে। কিন্তু না। তাদের কোনো আশাই সফলতার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেননি। প্রবাসেও নির্যাতন প্রবল শক্তিতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে কার্পণ্য করেনি। হতদরিদ্র এসব নিঃস্ব নারী তাদের সবকিছু বিক্রি করে বিদেশে যাওয়ার পথ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সে পথ তাদের জন্য মসৃণ হতে পারেনি। গত এপ্রিলে রিয়াদ থেকে একইভাবে ফিরে এসেছেন ৫০২ নারী গৃহকর্মী।
এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবে কখনোই এই শ্রমিকদের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করা হয়নি। যৌন নিপীড়নসহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে প্রচুর নারীকে আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন কিংবা হচ্ছেন। তাদের মাথার ওপর এখন কোনো ছাদ নেই। পায়ের নিছে যে মাটির অস্তিত্ব ছিল, তাও সরে গেছে। সৌদি আরবে এ সময় বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীর সংখ্যা লক্ষাধিক। তাদের পাঠানো টাকার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের মান-ইজ্জত-সম্ভ্রম। অথছ দেশে কিংবা প্রবাসে কোথাও আমরা তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারিনি। সম্ভবত এর একমাত্র কারণ সভ্যতার তথাকথিত দর্শন, ‘শক্তি যার দুনিয়া তার’।
আমরা মনে করি, এ দর্শন মানব প্রজাতির জন্য কোনো দর্শন হতে পারে না। মানব প্রজাতির দর্শনকে হতে হবে প্রেম ও ভালোবাসায় নিমজ্জিত এক বিশ্বপরিবার। দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার নয়। বিশেষ করে নারীদের প্রতি। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা এই নারী জাতিকে যে মর্যাদায় বসিয়েছেন এবং মানুষের প্রতি যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তার সবটুকুই আমরা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছি। রাসুল (সা.) আমাদের জানিয়েছেন, ‘আল্লাহর পর কাউকে যদি সেজদা করার রেওয়াজ থাকত, তাহলে তিনি হতেন তোমাদের মা।’
পিডিএসও/হেলাল