হিমেল আহমেদ

  ২০ মে, ২০১৮

বন্যা মোকাবিলায় প্রস্তুতি কতটা

বাংলাদেশ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঘূর্ণিঝড় হোক অথবা বন্যা। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ উন্নত হচ্ছে কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে পুনরায় পিছিয়ে পড়ে! বন্যা এ রকম এক দুর্যোগ, যার কারণে প্রতি বছর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের হাত নেই, তবে আগাম সতর্কতা ও ব্যবস্থাপনা ক্ষয়ক্ষতি কমাবে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অফিস ইতোমধ্যে আগাম সতর্কতা জারি করেছে। আগাম বন্যা ২০১৬ সালের বন্যার ভয়াবহতাকে হার মানাবে।

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। তাই বন্যা হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষার আগেই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, দেশের অধিকাংশ নদ-নদী, খাল-বিলের বেহালদশা ও পর্যাপ্ত পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকা বন্যার প্রধান প্রধান কারণ। গত বছর আমরা দেখেছি, দেশের হাওর ও নিম্নাঞ্চল কীভাবে বন্যায় ডুবে গিয়েছিল। অনেক মানুষ, গবাদি পশু ও ফসলের ক্ষতি হয়েছিল। এবার যেন এসবের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে সরকারসহ সবাইকে আগে থেকেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এ বছর বর্ষার আগেই তুমূল বর্ষণের কারণে আগাম বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

দেশে ইতোমধ্যে গত ৩৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়ে গেছে। তুমূল বৃষ্টির কারণে দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বন্যার শঙ্কা রয়েছে। আগস্টের তৃতীয় বা শেষ সপ্তাহে বড় বন্যার আশঙ্কা হতে পারে বলে গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। ফলে উপকূলের মানুষ হারাচ্ছে বাসস্থান। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বন্যাও হানা দিচ্ছে অসময়ে। জরিপ বলছে, ২০১৬ সালের সংঘটিত বন্যা ১৯৮৮ সালের বন্যার পর সবচেয়ে বড় বন্যা। এতে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের মোট ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ২১০০ সাল নাগাদ যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের তিন মিলিয়ন হেক্টর জমি প্লাবিত হতে পারে। ফলে তীব্র বন্যার কবলে পড়বে নিম্নাঞ্চল।

সম্প্রতি সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলের পানি পরিমাপ করে গবেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে চীন ও বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপদে পড়বে বলে নাসা ইতোমধ্যেই সতর্ক করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উপরিভাগের তাপমাত্রা যদি ক্রমবর্ধমান থাকে তাহলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের গড় উচ্চতা প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার বাড়বে এবং এতে প্রায় ১৪ শতাংশ স্থলভূমি স্থায়ী ও অস্থায়ী জলনিমজ্জনের শিকার হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় তাপমাত্রা ও ভারী বৃষ্টিপাত, ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস পর্যবেক্ষণ করা গেছে। অল্প বৃষ্টিতেই দেশের প্রধান প্রধান শহর পানিতে ডুবে যায়। রূপ নেয় জলাবদ্ধতা। এরূপ চলতে থাকলে বাংলাদেশে বন্যা একটি স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নেবে এবং তা দেশের প্রায় অর্ধেক ভূখণ্ড গ্রাস করবে।

যত দিন যাচ্ছে জনসংখ্যা বাড়ছে, ছোট হয়ে আসছে খাল, বিল আর নদীগুলো। দেশের অধিকাংশ ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুরবস্থার কারণে বৃষ্টিতে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোও পানিতে তলিয়ে যায়। আর ভারী ও টানা বৃষ্টিতে এ সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। জলাবদ্ধতার প্রধান একটি কারণ হলো ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতা। ডাস্টবিন থাকা সত্ত্বেও ময়লা-আবর্জনা ড্রেনে ফেলা হয়। ফলে পানি নিষ্কাশনে বাধার সৃষ্টি হয়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব ছোট-বড় শহরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বর্জ্য ও আবর্জনার তুলনায় ডাস্টবিনের সংখ্যা অনেক কম। শুধু রাজধানী ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার কঠিন বর্জ্যরে পরিমাণ তিন হাজার টনের বেশি! যে ড্রেন দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয়, সেই ড্রেনগুলো আজ আমরা নিত্যদিনের বর্জ্য দিয়ে ভরাট করে ফেলছি। অপ্রতুল ডাস্টবিন থাকায় মানুষ ড্রেন, রাস্তাঘাট, খাল, বিল কিংবা পুকুরকেই ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছে! ফলে বন্ধ হয়ে পড়ছে পয়োনিষ্কাশনের পথ।

জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট কারণেই বন্যা সংঘটিত হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বন্যার অন্যতম সমস্যা হলো নদ-নদী, খাল-নালা অল্প কিছু লোভী ও ভূমিদস্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে না পারা। এদিকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বনভূমি ও প্রাকৃতিক বনজসম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত অবকাঠামো নির্মাণ, নগরের পানি ও পয়োনিষ্কাশনের পর্যাপ্ত পরিকল্পিত ব্যবস্থা না থাকা নগরে বন্যার অন্যতম কারণ। এখনই উচিত ড্রেনেজ সমস্যার সমাধান করা। নদ-নদীর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা। আগাম বন্যার ভয়াবহতা থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে বন্যা আসার আগেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা আজ সময়ের দাবি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
উন্নয়ন,বন্যা,কলাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist