রহিম আবদুর রহিম

  ০৪ মে, ২০১৮

পশুরাই প্রমাণ করলো ওরাই উত্তম

কনকনে শীত, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, ২০ এপ্রিল ২০১৮। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের দুর্গম এলাকার একটি বাড়ি থেকে ‘অরোরা’ নামের তিন বছর বয়সী একটি শিশু বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। শিশুটি যে কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, বাড়ির কেউ তা জানে না। শিশুটির আত্মীয়-স্বজন তন্নতন্ন করে খুঁজে ফিরছে; কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে অভিভাবকমহল বিষয়টি থানা পুলিশ পর্যন্ত জানাতে বাধ্য হয়। ১৫ ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে ওই বাড়ির ম্যাক্স নামের পোষা অন্ধ কুকুরটিকে তারা খুঁজে পায়। প্রভুর আগমন টের পেয়ে অন্ধ ম্যাক্স তাদের গায়ে ঠেলে ঠেলে হারিয়ে যাওয়া অরোরার কাছে নিয়ে যায়। পাহাড়ঘেরা দুর্গম এলাকার হিংস্র পশুর হাত থেকে শিশুটিকে রক্ষার জন্য এই ম্যাক্সই ১৫ ঘণ্টা শিশুটিকে তার বুকে আগলে রেখেছিল।

শিশুটিকে খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটি পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে বিস্তারিত শোনে এবং ম্যাক্সের ওপর পুলিশ খুশি হয়। পুলিশ বিষয়টি সাংবাদিকদের জানায়। সাংবাদিকরা ম্যাক্সের ছবিসহ খবরটি অস্ট্রেলিয়ার বহুল প্রচারিত ‘এবেলা’ পত্রিকায় প্রকাশ করে। প্রকাশিত সংবাদটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ৬৩ হাজার লাইক এবং ১০ হাজার বার এই সংবাদটি শেয়ার করে বিশ্বকে জানিয়ে দেয় ম্যাক্সের মহৎ গুণের বিষয়টি। এই সংবাদটি আমাদের দেশের জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকাতেও অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে।

২০১১ সালের নভেম্বর মাসে জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘মায়ের কোলে ওদের ঠাঁই হয়নি।’ শিরোনামে বডিতে বলা ছিল অপকর্মের ফসল নবজাতক শিশুদের যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হচ্ছে। গত ১৭ নভেম্বর এমন দুটি শিশু পাওয়া গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। রিপোর্টার ঢাকা মেডিকেল কলেজের বরাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘চলতি বছরের ২৮ মে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ ওইদিন একটি নবজাতক শিশু উদ্ধার হয়েছে ঝিনাইদহের শৈলকুপায়। দুটি কুকুরের মহৎ গুণে ওই শিশু বেঁচেছিল। কে বা কারা উপজেলার হাবিরপুর চাতালের পাশে শিশুটিকে ফেলে যায়। রাতভর দুটি কুকুর এই নবজাতক শিশুকে পাহারা দেয়। সকালে চাতালশ্রমিক সখিরন নেছা শিশুটিকে উদ্ধার করে। গত ২৮ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতা সিঙ্গেল কলামে প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘বড়দের শত্রুতায় প্রাণ গেল শিশুর।’ সংবাদের বডিতে বলা হয়েছে নিখোঁজের ১৭ ঘণ্টা পর বাড়ির আঙিনার সবজি মাচায় পাওয়া গেছে তিন বছরের শিশু তামিম হোসেনের লাশ। ধারণা করা হচ্ছে, শত্রুতার জেরে এই শিশুটিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে খুনিরা। আর আক্রোশ প্রকাশ করতেই হত্যার পর শিশুটির লাশ বাড়ির আঙিনায় ফেলে গেছে। নির্মম এই ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) রাতে রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার মাটিকাটা বাইপাস এলাকায়। নিহত তামিম হোসেন, নির্মান শ্রমিক রাসেল হোসেনের ছেলে। গত ২৭ এপ্রিল একটি অনলাইন পোর্টালের একটি সংবাদে প্রকাশ ‘লাবিব নামের ৬ বছর বয়সী এক শিশুকে অপহরণের পর জুসে নেশাজাতীয় ওষুধ মিশিয়ে হত্যা করেছে অপহরণকারীরা। নিহত শিশু জামালপুর সদর উপজেলার বাঁশচড়া ইউনিয়নের ঝাউলা গোপালপুরের বন্দেবাড়ি গ্রামের ওমান প্রবাসী ইউসুফ আলীর ছেলে। ২৮ এপ্রিল অন্য একটি অনলাইন পোর্টালের একটি সংবাদ ছিল, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বৈদ্যের বাজার ইউনিয়নের দাউদেরগাঁও গ্রামে সৌদি প্রবাসী আনিসুর রহমানের মেয়ে ‘আনিছা’র লাশ একটি পানির ট্যাঙ্কি থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। আনিছা সোনারগাঁ উলুকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। শিশুটি ২৩ এপ্রিল প্রাইভেট পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হয়। তাকে বিভিন্ন স্থানে খোঁজার পর বুধবার

মেয়েটির চাচা আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে থানায় জিডি করেন। শুক্রবার সকালে উলুকান্দি গ্রামের আবদুল মালেক মিয়ার নির্মাণাধীন দ্বিতীয় তলার পানির ট্যাঙ্কি থেকে শিশুর লাশটি পুলিশ উদ্ধার করে। সংবাদটিতে এই শিশু খুনের কোনো ক্লু উল্ল্যেখ নেই। আমার ধারণা এই খুনটি ধর্ষণের পর হতে পারে। ২৮ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদে প্রকাশ, নাটোরের গুরুদাসপুরে তিন বছর বয়সের ও বড়াই গ্রামের দুই বছর বয়সের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য থানায় কেউ অভিযোগ করেনি। শিশু নুসরাত ধর্ষণের পর খুন হয়েছে। আট বছরের পূজা, সাদিয়ারা মানব পশুদের হাতে জীবন দিয়েছে। লেখাটি যখন তৈরি করি, তখন দেবরের সঙ্গে ভাবির পরকীয়ার আগুনে পুড়িয়ে নিজ শিশু সন্তানকে হত্যার জঘন্য খবরটিও চোখ এড়ায়নি। গত দুই দিনের বিভিন্ন মিডিয়ার খবর অনুযায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচটি নিষ্পাপ শিশু হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই হিসাব অনুযায়ী প্রতি মাসে শিশু হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ১৫০টি। বছরে দুই হাজার শিশু খুন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অপ্রকাশিত এরকম হাজারো ঘটনাতো রয়েছেই। সভ্যতা-মানবতা কোথায় এসে ঠেকেছে!

সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে আট বছর বয়সী শিশু আসিফাকে একটি মন্দিরের ভেতর আটকে রেখে নরপিশাচরা গণধর্ষণ করেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা ভারত ক্ষোভে ফুঁসে উঠে। ভারত সরকার শিশু ধর্ষণকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাস করেছে। আইয়্যামে জাহেলিয়া যুগের কথা শুনেছি, ঘোড়ার পেছনে নারীদের বেঁধে ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করে ওই সময়ের মানবপশুরা উল্লাস করত। নারী শিশুদের আঁতুর ঘরেই মেরে ফেলা হতো। গোত্রে গোত্রে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে হানাহানি, খুনোখুনির নির্মম যুগ পেরিয়ে আমরা সভ্য যুগের পরম শিখড়ে বসবাস করছি। মানবতা, মনুষ্যত্ব, আইন-আদালতের এই জগতের একি হচ্ছে! আমি ব্যক্তিগতভাবে কুকুর দেখে ভয় পেতাম, আজ তিন দিন ধরে কুকুরের ওপর ভয় কেটে গেছে। ওদের আদর করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। পাশাপাশি মানুষ দেখলেই কেমন জানি মনে সন্দেহ জাগছে। তবে, ‘দ্বারবদ্ধ করে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি।’ বাণীটি বুকে ধারণ করে সময় পার করছি। জঙ্গল ঘেরা ঐরাবত (পাগলা হাতি) যখন লোকালয়ে প্রবেশ করে তাণ্ডব চালায় তখনও এই হিংস্র পশুরা শিশুর গায়ে স্পর্শ করে না। আমরা দেখেছি কোনো পশুই কোনো পশুর বাচ্চাকে ধর্ষণ করেনি, হত্যা করেনি। অন্ধ কুকুর ম্যাক্স কিংবা ঝিনাইদহের সেই দুটি কুকুরের মাহাত্মের কাছে মানুষ নামের এই জানোয়ারদের কোনো মূল্য আছে? কুকুররাই প্রমাণ করল তারা কুকুর নয়, মনুষ্য পশুরাই প্রমাণ করছে তারাই অধম। ভারতের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে যদি ভারতের মানবতা ফুঁসে উঠতে পারে। আমরা কেন দেশের মনুষ্য

পশুদের নিষ্পাপ শিশু ধর্ষণ খুনের মহোৎসব নীরবে অবলোকন করছি। তবে কি দানবরূপি মানুষের কাছে আমাদের মানবতার মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে! আমরা কি এদের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারি না? আর উপেক্ষা-অপেক্ষা নয়, শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকার, শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজকে একযোগে এদের হিংস্রতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কাজ শুরু করার সময় এসেছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কলাম,কুকুর,শিশু
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist