reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৯ এপ্রিল, ২০১৮

মহিমান্বিত শাবান মাসের গুরুত্ব ও আমল

পবিত্র শাবান মাস ও মহিমান্বিত এই মাসের বুকে ধারণকৃত বরকতময় রজনী শবেবরাতের ফজিলত ও গুরুত্বের কথা ঘোষিত হয়েছে হাদিসে নববির অসংখ্য স্থানে। আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম তো বলেই দিয়েছেন, শাবান আমার মাস আর রমজান আল্লাহর মাস। রাসুল সা. এ মাসে প্রায়ই রোজা রাখতেন। হযরত আনাস বিন মালিক র. সে যুগের মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরে বলেন, তখন শাবান মাসের আগমন ঘটলে মুসলমানরা বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াতে মনোনিবেশ করতেন এবং বিত্তশালীরা তাদের মালামালের জাকাত-সাদকা বিতরণ করতে থাকতেন ফকির মিসকিনদের কাছে যাতে অভাবগ্রস্ত পরিবারগুলো একটু স্বস্তি ও শক্তি সঞ্চয় করে ভালোভাবে অতিবাহিত করতে পারে রমজানের রোজাগুলো। আজকে আমাদের সমাজে সে ঐতিহ্যমণ্ডিত চিত্রটি বিরাজ করলে কত না সুন্দর হতো!

শাবান মাস আল্লাহর রহমত ও রেজামন্দি হাসিলের এক সোনালি সুযোগ নিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে। পাপি-তাপিসহ সব উম্মতে মুসলিমা এই মহিমান্বিত মাসের সদ্ব্যবহার করে নিজের ইহপরকালীন জীবনকে সৌভাগ্যম-িত করে নিতে পারি। তবে এ ক্ষেত্রে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি দরকার তা হলো খুলুসিয়াত ও সমর্পিত মন নিয়ে আল্লাহর রেজামন্দি তালাশ করা। দেহমন উজাড় করা, প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে প্রভুর ইবাদত-বন্দেগিতে ডুবে থাকা। এ সময় কুরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল পাঠ, রোজা ও নফল নামাজ আদায় করা আর যথাসাধ্য দান-খয়রাত করা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ।

শাবান মাসের আগমন হলেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন কতিপয় বিশেষ কাজ করতেন, যা অন্য মাসসমূহ থেকে এ মাসের স্বাতন্ত্র নির্দেশ করে। যেমন শাবান মাসের পূর্বে রজব মাস শুরু হলে তিনি এ মর্মে দুআ করতেন- ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রামাদান’। অর্থ- হে আল্লাহ! আপনি রজব ও শাবান মাসকে আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমজান মাস পর্যন্ত (হায়াত দিন) পৌঁছে দিন। [বায়হাকী শরিফ]

-বরকত বলতে ইবাদত বন্দেগির বরকতই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আমাদের অন্যান্য মাসের তুলনায় এ দু’মাসে অধিক পরিমাণে ইবাদত বন্দেগি করার তাওফিক দান কর এবং আগামী রমজানের আমাদের জীবিত রেখো, যাতে আমরা রমজানের সুফল লাভ করতে সক্ষম হই।

এই দুআর একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়ছে। রমজান মাসের সকল নেক আমলের সওয়াব অন্য সময়ের তুলনায় কমপক্ষে সত্তর গুণ বেশি। সুতরাং সে মাসে অন্য মাসের তুলনায় অধিক পরিমাণে নেক কাজ করা মুমিন বান্দাদের একান্ত করণীয়। কিন্তু দীর্ঘ ১১টি মাসের অভ্যাস হাঠাৎ করে পরিবর্তন করা যায় না। বরং আস্তে আস্তে অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটাতে হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সত্যটির প্রতি নিজ উম্মতকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। রজব মাসের আগমন যেন রমজান মাসের আগমনী বার্তা।

সুতরাং তখন থেকে নিজের দেহ-মন-আচরণ ও মানসিকতায় এমন পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে, যাতে মাহে রমজানুল মুবারক শুরু হবার পূর্ব থেকেই প্র্রস্তুতি গ্রহণ হয়ে থাকে এবং পবিত্র রমজানের বরকত ও সুফল যথাসম্ভব উচ্চ মাত্রায় অর্জনের চেষ্টা রমজানের প্রথম মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে যেতে পারে। যদি দু’মাস পূর্ব থেকে এরূপ প্র্রস্তুতি চলতে থাকে তাহলে রমজানের একমাস পূর্বে অর্থাৎ শাবান মাসে এই প্র্রস্তুতি যে আরো জোরদার হতে হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

গবেষণায় শাবান মাসের ফজিলত বিষয়ে একটি বিশুদ্ধ হাদিস পাওয়া যায়। হাদিসটি হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা অর্ধশাবানের রাত মানুষের জন্য আনয়ন করেন এবং প্রত্যেক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক ও মুশাহিনকে ক্ষমা করেন না। (মুশাহিন বলা হয় এমন মানুষকে, যারা সুন্নাহর বিরোধিতা করেন এবং সাহাবা রা. কে অভিসম্পাত করেন)। [সিলসিলাতু আহাদিস- আস-সাহিহা- ১১৪৪]

ইবনে হিব্বান অর্ধশাবানের রাত্রি জাগরণের ফজিলতের ক্ষেত্রে বর্ণিত কিছু কিছু হাদিসকে সহিহ বলেছেন। যেমন, আয়েশা সিদ্দিকার রা. হাদিস। তিনি বলেন, আমি একদিন রাসুল সা. কে খুঁজছিলাম। হঠাৎ তাকে বাকিতে হাত উত্তোলন করা অবস্থায় পেয়ে গেলাম। তিনি বললেন, তুমি কি আশঙ্কা কর যে, আল্লাহ ও তার রাসুল তোমার উপর অন্যায়-অত্যাচার করবে? তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি ভেবেছিলাম, আপনি কোনো স্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তা’লা অর্ধশাবানের রাত্রে পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন, তারপর ক্ষমা করেন অজ¯্র-অগণিত মানুষকে। [ইমাম বুখারি প্রমুখ হাদিসটিকে জয়িফ বলেছেন]

সারমর্ম: এ বিষয়ে সবচেয়ে সুন্দর কথা হচ্ছে, যা শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন, অর্ধশাবানের রাত্রে নামাজের ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়াকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, যদি কেউ অর্ধশাবানে এককভাবে কিংবা বিশেষ কোনো জামাতের সাথে নামাজ পড়ে, যেমন পূর্বসূরি আলিমগণ পড়তেন- তবে তা উত্তম। কিন্তু মসজিদে সুনির্দিষ্ট নিয়মানুসারে নামাজের জন্য একত্র হওয়া সম্পূর্ণই বিদআত।

আর বিদায়াত হলো- কোন প্রমান ছাড়া শরিয়াতের কোন বিধান পালন করা। [মাজমু- ফাতাওয়া শায়খুল ইসলাম, খ-: ২৩, পৃষ্ঠা: ১৩১] (মধ্যম পন্থা অবলম্বনই শ্রেয়তর] সাহাবায়ে কেরাম বলেন, মহানবী সা. শাবান মাসের দিন তারিখের এতই হিসাব রাখতেন যে, অন্য মাসগুলোতে তেমন রাখতেন না। এর কারণ মহানবী সা. নিজেই বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, তোমরা রমজানের জন্যই শাবান মাসের হিসাব রাখবে। শাবানের সাথে রমজানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। যদি ২৯ শাবান আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারণে রমজানের চাঁদ দেখা না যায়, তাহলে শাবান মাসের ৩০ দিন পূর্ণ করতে হবে। এ কারণে শাবান মাসের তারিখ হিসেব রাখা প্রয়োজন। তাছাড়া মহানবী সা. এর নিয়ম ছিল, তিনি এ মাসে প্রচুর পরিমাণে নফল রোজা রাখতেন।

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী সা. শাবান মাসের অল্প কদিন রোজা বিহীন থাকতেন। যে সকল মধ্যরাতে দোয়া অবশ্যই কবুল হয়। (ক) রজবের প্রথম রাত (খ) অর্ধশাবানের রাত। (গ) জুমার রাত। (ঘ) ঈদের রাত। (ঙ) কুরবানির রাত। [লাতায়েফুল মাআরিফ- ১৫২] আল-বানি এ হাদিসের সনদকে মওজু বলেছেন। তবে এই রাত্রে আল্লাহ পাক সব বান্দাদেরকে মাফ করে দিলেও কতিপয় বান্দাদের মাফ করবেন না যেই পর্যন্ত না সেইসব হক্ক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে তওবা-ইস্তেগফার করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

১- শিরক বা আল্লাহর সাথে শরিক করা।

২- পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান বা বাবা-মাকে কষ্ট বা আঘাত দেওয়া সেই সব ছেলে-মেয়ে।

৩- জেনা বা ব্যভিচার কারী নারী-পুরুষ।

৪-মদ-জোয়া-আর সুদ দেওয়া-নেওয়া, গ্রহণ ও গ্রহীতাকারী।

৫- আত্মীয়তার সম্পর্ক যে ছিন্ন করে।

হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত আছে যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,আল্লাহ পাক বিশেষ চার রাত-এ তাঁর খাস রহমের দরজা বান্দার জন্য খোলে দেন, আর তা হলো-

০১- ঈদ-ঊল-ফিতর এর রাত।

০২- ঈদ-ঊল-আযহার রাত।

০৩- ১৫-ই শাবানের রাত।

০৪- আরাফাতের বা হজের রাত থেকে ফজর পর্যন্ত।

সহিহ হাদিসে বর্ণিত আছে, এই রাতে কবর জেয়ারত বিশেষ এক ফজিলত, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এই রাতে জান্নাতুল বাকিতে জেয়ারত করেছেন বলে আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে।

উল্লিখিত হাদিসসমূহ থেকে আমরা শাবান মাসের করণীয় সম্পর্কে যা পেলাম তার সারাংশ দাঁড়ায় নিম্নরূপ-

১. শাবান মাসের তারিখসমূহের হিসাব রাখা, যাতে মাসের শেষদিকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার দরূণ চাঁদ দৃষ্টি গোচর না হলে কোন গোলযোগের মধ্য পড়তে না হয়।

২. রমজানের প্র্রস্তুতি হিসেবে অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক পরিমাণে ইবাদত বন্দেগির অভ্যাস গড়ে তোলা। তাছারা মন-মস্তিষ্ক ও আচরণ পরিশুদ্ধ করার জন্য সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন। তাহলে পূতঃপবিত্র দেহ-মন নিয়ে রমজানুল মুবারকের করণীয়সমূহ পালন করা যাবে। ফলে পবিত্র মাসের বরকত, রহমত ও মাগফেরাত লাভের যোগ্যতা অর্জিত হবে।

৩. একই সাথে শারীরিক সুস্থতার প্রতি নজর দেওয়াও শাবানের অন্যতম কর্তব্য। কেননা, শরীর সুস্থ না থাকলে ইবাদত পালনে উদ্যম আসে না। যেহেতু দীর্ঘ একমাস কৃচ্ছসাধন করতে হবে, সেজন্য পূর্ব থেকে যাতে দুর্বলতায় পেয়ে না বসে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

৪. শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত অত্যন্ত ফজিলতের রাত। এ রাতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু কয়েক শ্রেণীর মানুষ এ রাতে আল্লাহর ক্ষমার আওতায় পড়বে না। যথা- মুশরিক, মদ্যপ, মাতাপিতার অবাধ্য, মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষী, চাঁদাবাজ প্রভৃতি। অতএব, এসব কাজ থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। তাহলেই শাবান মাসের করণীয় পালন করা হবে এবং শবে বরাতের কল্যাণ ও রহমত অর্জন করা যাবে।

মধ্য শাবানের পর রমজান মাসের আগমনের আর বেশি সময় থাকে না। মাত্র ১৪-১৫ দিন। শবেবরাতে আল্লাহ মহানের কাছে পবিত্র জীবন কামনার সাথে সাথে আসন্ন রমজানে সুস্থ দেহ মন ও সুন্দর পরিবেশের জন্য দোয়া করা দরকার। এ সময় ইবাদত ও তিলাওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। চাকরি-বাকরিতে সততা, ব্যবসা-বাণিজ্যে হালাল পথ অনুসরণ করতে হবে। সহায়তা করতে হবে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার কাজে। মসজিদ-মক্তবগুলো আবাদ করতে হবে রোজাদার মুসল্লিদের সুবিধার্থে। তাহলেই কেবল পুণ্যময় মাসগুলোর (রজব, শাবান ও রমজানের) ক্রমাগমন আমাদের জীবনে সফলতা বয়ে আনবে।

কোন প্রকারের উৎসব, আতশবাজি কিংবা হৈ-হুল্লোড় করে অযথা সময় নষ্ট না করে এবং গুণাহের এই সব কাজ না করে আমাদের সকলের উচিৎ হলো- এই রাতে দোয়া-দুরুদ আর নফল ইবাদত-বন্দেগি করে রাত পার করা এবং নফল রোযা রাখা, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব বিশেষ করে মা-বাবাকে খুশি করা, যাতে আলাøহ পাক এবং তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খুশি করা। মনে রাখবেন সকল দোয়ার আগে-পিছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ পড়ে দোয়া শুরু এবং শেষ করলে দোয়া সরাসরি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। (সংক্ষেপ) - মুফতি : আশরাফুল ইসলাম

পিডিএসও/মুস্তাফিজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শাবান মাস,গুরুত্ব ও আমল,মহিমান্বিত
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist