ডা. এস এ মালেক
কোন পথে রোহিঙ্গা সংকট
ঠিক যা প্রত্যাশা করা গিয়েছিল, রোহিঙ্গা সংকট সেই পর্যায়ে পৌঁছায়। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে নেবে এ রকম কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। বরং তারা সেই পুরোনো গো-ধরে বসে আছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন। তারা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার গিয়ে বসতি স্থাপন করেছেন। ভাষা, আকৃতি ও প্রকৃতিতে তারা প্রায় বাংলাদেশের মানুষের অনুরূপ। তাই মিয়ানমার সরকার তাদের আরাকান অঞ্চলে ফিরে যেতে দেবে না। ফিরে যেতে দেবে না বলেই তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটার পর একটা দফতর স্থাপন করেছে। বুলডোজার চালিয়ে এমন অবস্থা করা হয়েছে, এখন ভিটাবাড়ির কোনো চিহ্নই রাখেনি।
শোনা যায়, তাদের জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতায় ছোট ছোট কলোনি স্থাপন করা হবে এবং সেখানে তারা নাগরিকত্ববিহীন অবস্থায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে বসবাস করবে। অর্থাৎ, ফিরে গিয়ে স্বাধীন জীবনযাপন তো দূরের কথা, সেখানে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হবে। রোহিঙ্গাদের বক্তব্য—তারা ফিরে যেতে চায়। তবে তাদের অবশ্যই নাগরিকত্ব ও সর্বপ্রকার নাগরিক অধিকার দিতে হবে, আগের সব সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। মিয়ানমারের একজন সাধারণ নাগরিক যে অধিকার ভোগ করবে, তাদেরও সেই অধিকার দিতে হবে। এটাই তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পূর্বশর্ত। যে দেশে তারা কয়েক শ বছর ধরে বসবাস করছে, খাদ্যশস্য উৎপাদন করে মিয়ানমারের জনগণকে খাইয়েছে, অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও অবদান রেখেছে এবং একসময় সংসদে নির্বাচিতও হয়েছে, তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দলও ছিল, সেই দেশে গৃহবন্দি অবস্থায় থাকার জন্য তারা ফিরে যাবেন কেন?
প্রায় সাত মাস পার হয়েছে। আগের ও বর্তমান মিলিয়ে শরণার্থীদের মোট সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এই ১২ লাখ বিদেশিকে কী করে বছরের পর বছর ভরণ-পোষণ করবে বাংলাদেশ সরকার? তা ছাড়া সাত মাসে আসা উদ্বাস্তুর সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। তাদের মধ্যে মাত্র তিন সপ্তাহে এসেছে তিন লাখ। দুটি উপজেলা ও পার্বত্য অঞ্চল প্রায় তাদের দখলে চলে গেছে। তাদের কারণে স্থানীয় জনগণ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। তাই পারস্পরিক বিরোধ অবধারিত হয়ে পড়েছে। তাদের কারণে বনাঞ্চল প্রায় ধ্বংসের মুখে, প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। এমনকি অত্র অঞ্চলের বন্য প্রাণীরাও আজ বিপর্যস্ত। তা ছাড়া এত বহুসংখ্যক লোককে এত স্বল্পস্থানে আশ্রয় দেওয়াতে স্বাস্থ্য সংকটও দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় বারবার আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় ভেটো দিতে তা প্রতিরোধ করা হয়েছে। চীন ও রাশিয়া রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিতে রাজি নয়। পাশের রাষ্ট্র ভারত এ ব্যাপারে সক্রিয় হতে পারেনি। জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময়ে এসে পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখে যাচ্ছেন। মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্যও করেছেন। দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। পৃথিবীর অনেক দেশের সরকারপ্রধানরা এসে স্বচক্ষে রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা দেখেছেন এবং প্রায় সবাই একে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে অভিহিত করেছেন। সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে শাস্তির প্রস্তাব জানিয়েছেন। দাবি উঠেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধী হিসেবে বিচার করার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। কথা দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেও বিগত সাত মাস মিয়ানমার সরকার ৭০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেননি।
বিশ্ববিবেক আজ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। দু-চারটি দেশ ছাড়া সব দেশের সরকারপ্রধান, রাজনৈতিক নেতা ও মানবাধিকার সংগঠন সবার দাবি রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে। আর মিয়ানমারের কথা হচ্ছে—কলাকৌশল করে সময়ক্ষেপণ করে যাবেন, কিন্তু দেশে ফিরতে দেবেন না। এমতাবস্থায় করণীয় কী? বাংলাদেশের বাস্তবতা এমন নয়, একটা ভূ-খণ্ড ছেড়ে দিয়ে তাদের চিরদিনের জন্য পুনর্বাসিত করবে এবং তা করা হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে। নিশ্চয়ই জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্যরা বছরের পর বছর অনুদান দিয়ে রোহিঙ্গাদের এভাবে ক্যাম্পে ভরণ-পোষণ দিতে পারবে না। একটা পর্যায়ে নামমাত্র জাতিসংঘের নামে সাহায্য আসবে বটে কিন্তু বাংলাদেশ সরকারকে মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং তা করা হলে বাংলাদেশের জন্য যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে, তা বিবেচনায় নিলে বিস্মিত হতে হয়। মিয়ানমার যদি তার দেশে নাগরিক ফেরত না নেয় এবং জাতিসংঘ যদি এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে না পারে, তাহলে পৃথিবীর অনেক দেশের যেখানে জাতিগত নিধনের মতো পরিবেশ বিরাজমান, সেখান থেকে সহজেই সে দেশের নাগরিকদের বিতাড়িত করা হবে। তাই মিয়ানমার প্রশ্নে জাতিসংঘ অত্যন্ত কঠোর আকার ধারণ করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে না পারে, তাহলে বিশ্ব এক করুণ পরিণতির শিকার হবে। কোনো দেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নিরাপদে থাকতে পারবে না এবং তা হবে মানবসভ্যতার এক চরম কলঙ্ক। তাই বিশ্বসমাজ ও বিশ্ব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা সংকট বিবেচনায় নিয়ে এরূপ সংকটে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে না পারলে, জাতিসংঘ থেকে লাভ কী?
বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত মানবতাবাদী সংকটকালে বিশ্ব রাজনীতিকে ঊর্ধ্বে রাখা। বৃহৎ শক্তির সামরিক স্বার্থকে বড় করে না দেখা, মানবতাকে সমুন্নত রাখা। পৃথিবীর যেসব দেশে এ ধরনের সমস্যা রয়েছে, যেমন : ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন সেখানে বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে ছোট করে দেখে মানবতাবাদী হয়ে বিশ্ব রাজনীতির কান্ডারি হিসেবে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করা। কোনো ইস্যু যদি বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে, তখন তাদের উচিত ওইসব ইস্যুতে উদার মনোভাব গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সংকটের সমাধানের প্রকৃত পথ খুঁজে বের করা। রাশিয়া, চীন ও ভারত আন্তরিকতার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে কাজ করলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এশিয়ায় যতগুলো সংকট বিদ্যমান রয়েছে, রোহিঙ্গা সংকট তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও ভারতের উচিত বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করা। এ দুটি বৃহৎ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ইউরোপ আমেরিকার সুদূর অঞ্চলে যারা বিশ্ব রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্ব করে, তারা রোহিঙ্গা সংকটের নৈতিক সমর্থন জানাতে পারেন। কিন্তু চীন ও ভারতকে এ সংকটের সমাধানে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে মানবিক আচরণ করেছেন এবং যেভাবে সহনশীলতার সঙ্গে এ সংকট মোকাবিলা করতে চেয়েছেন, তাকে অবশ্যই সমর্থন করা উচিত চীন ও ভারতকে। আর মিয়ানমারকে অবশ্যই যুক্তিবাদী হতে হবে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করে এ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় ধন্যবাদ জানান এবং আশাবাদ ব্যাক্ত করেন, রোহিঙ্গা সংকট শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য মহাসচিবকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সংকট সেই অবস্থাতেই আছে, কোনো অগ্রগতি নেই। তিনি জাতিসংঘের মহাসচিবকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং প্রত্যক্ষভাবে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা অবগত হন। যত দ্রুত রোহিঙ্গা সংকট সমাধান হবে, ততই বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক।
পিডিএসও/হেলাল