ডা. এস এ মালেক

  ০৮ এপ্রিল, ২০১৮

উন্নয়ন : দুর্নীতি ও বাস্তবতা

প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। একটা দেশের প্রবৃদ্ধির গড় দেখে সে দেশের অর্থনৈতিক গতির উন্নয়ন নির্ধারণ করা যায়। প্রবৃদ্ধির হার যত ঊর্ধ্বমুখী হয়, উন্নয়নের গতিও সেভাবে ত্বরান্বিত হয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে যে যাই বলুক না কেন, প্রবৃদ্ধির হারই প্রমাণ করে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। এ দেশের অর্থনীতিবিদরা এর সঙ্গে একমত নন। যখনই বাংলাদেশ কোনো একটি ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রসর হয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করে, তখনই ওই অর্থনীতিবিদরা সামগ্রিক অর্থনীতির বিচার-বিশ্লেষণ করে টেকসই উন্নয়নের প্রশ্ন তুলে ওই বিশেষ অগ্রগতির ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব বলে মনে করেন না।

তাদের মতে, উন্নয়নের গতি যতই বেশি হোক না কেন, তাকে টেকসই করতে না পারলে তা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। অসহিষ্ণু এই অর্থনীতিবিদরা দেশের উন্নয়ন সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করতে অভ্যস্ত। এমনকি বার্ষিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধিকেও তারা কম দেখাতে অভ্যস্ত। এ দেশের অর্থনীতির বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে তারা বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত উন্নয়নের গড়কে সঠিক বলে বিবেচনা করার তাগিদ দেন। আমাদের অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়া-কর্মের সঙ্গে যারা জড়িত আছেন, তাদের তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান দিনের শেষে দেখা যায় তাদের বক্তব্য সত্য বলে প্রমাণিত। চলতি বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ বলে ধরা হয়েছে। এর আগের বছরে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ২০১৬-১৭ ছিল ১৬১০ মার্কিন ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৭৫২ মার্কিন ডলার। পরপর তিন বছর প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। এখন আমরা বিশ্বে ৪৩তম বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশ।

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের ক্ষেত্রে রোল মডেল। পৃথিবীর অনেক দেশই বিশেষ করে কৃষিপ্রধান দেশগুলো কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে আসছে। কৃষি কর্মকর্তাদের সৃষ্ট কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বৃহত্তর কৃষিব্যবস্থা বলতে যা বোঝায়, তা বিবেচনায় নিলে অনেক কৃষিপণ্য উৎপাদন, রফতানি ও অভ্যন্তরীণ সরবরাহের ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব ঘটেছে বলে মনে হয়। এ দশকের ভেতর শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়নি, বিদেশে রফতানি পর্যন্ত শুরু হয়েছিল। এবার পরপর কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হলেও আগামীতে আবার খাদ্যশস্য রফতানি করবে। মাছের চাষ বাংলাদেশে এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে মাছ রফতানি করে আমরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব। বিশ্বের অন্যতম ইলিশের চাষ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ রক্ষণ পদ্ধতিতে যেভাবে সমুদ্রে ও নদীতে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ইলিশ যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শুধু ইলিশ বিক্রি করেই শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব।

বাংলাদেশ কৃষিপণ্য উৎপাদনে যত কম ব্যয় করতে হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশে তা সম্ভব নয়। বিশ্বের অনেক দেশ আছে, যেখানে সার ছাড়া কোনো ফসলই উৎপন্ন হয় না। আর বাংলাদেশে একটা নারকেল বা তালের বীজ মাটিতে পুঁতে রাখলে, কোনো কিছু না করলেও তা ৩০-৪০ বছর ফল দিয়ে থাকে। পৃথিবীতে এমন কোনো জমি নেই, যেখানে কোনোপ্রকার চাষাবাদ না করে শুধু বীজ ছিটিয়ে দিলে প্রাকৃতিক নিয়মে ফসলের উৎপাদন হয়। বাংলাদেশের যেসব জলাশয় রয়েছে, তাতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে এবং নদীতে যেভাবে পোনা মাছ ছড়াচ্ছে, তা অব্যাহত রাখলে, শুধু মাছ বিক্রি করেই হাজার-হাজার কোটি টাকা অর্জন সম্ভব।

বাংলাদেশের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কৃষি ফসল পাট। আজ শুধু বস্তা বা কার্পেট তৈরিতে এ পাটের ব্যবহার হচ্ছে না, এ গাছের প্রতিটি অংশই বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে। পাট থেকে অর্গানিক চা পর্যন্ত উৎপন্ন হচ্ছে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, পাট থেকে উন্নতমানের সুতা তৈরি করে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানের কাপড় তৈরি হবে। পাটখড়ি আজ অত্যন্ত মূল্যবান বস্তু, যা থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনেক কিছুই তৈরি হচ্ছে। পারটেক্সের মতো দ্রব্যও পাট থেকে তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশের বৈজ্ঞানিকরা পাটের ওপর গবেষণা চালিয়ে যেসব কিছু উদ্ভাবন করেছেন, যা বিশ্ব কৃষি বিজ্ঞানীদের নজর কেড়েছে।

বিশ্বের উন্নতমানের প্রোটিন মাছ সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অসাধারণ সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের যেসব ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদিত হয়, বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করে তাদের পুষ্টিমান সম্পর্কে এমন সব তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে, যা পুষ্টি সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। শিম, বিট, কপি, ঢেঁড়স, পটোল, বিভিন্ন ধরনেরর শাকসবজি, মিষ্টি আলু, পেঁপে প্রভৃতি এমন সব ভিটামিন মিনারেল অ্যাক্টি-অক্সিডেন্ট আবিষ্কৃত হয়েছে, যাতে মনে হয়, মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে আমাদের খাদ্যশস্যে সব উপাদান সন্নিবেশিত করে দিয়েছেন। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিপণ্য ও কৃষি-সংক্রান্ত শিল্পের ওপরই নির্ভর করে। আমাদের মুদ্রাস্ফীতি কতটুকু হবে বা হবে না, তা মূলত খাদ্যশস্য উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে। সরকার যেভাবে কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে আমাদের কৃষি খাত দৃঢ় অবস্থানের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের মাটি এতই উর্বর, যাকে সোনার মাটি বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এ দেশের মাটিতে যে সোনা ফলে তা প্রমাণিত।

আমাদের দেশের অধিকাংশ বনাঞ্চল ও বনভূমি প্রকৃতিনির্ভর। খুলনার সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের গাঢ় অঞ্চলে যেসব বনভূমি রয়েছে, তা প্রাকৃতিক। আমাদের মাটি এতই উর্বর, আমরা যদি বনাঞ্চল ধ্বংস না করি, তাহলে প্রকৃতিগতভাবে বনাঞ্চল সংরক্ষিত থাকবে। এ কথা সত্য, আমাদের অর্থনীতির আর এক নির্ভরশীল ক্ষেত্র হচ্ছে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ। আর তৃতীয় ক্ষেত্র বোধ হয়, তৈরি পোশাকশিল্প। এই তিনটি ক্ষেত্রে যদি আমরা সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সফল কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে সক্ষম হই, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।

কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও মেহনতি মানুষের মুক্তিই ছিল রাজনীতির মূল দর্শন। বাংলাদেশে আজ যে ধনিক শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে, দলবল নির্বিশেষে তারা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। তাদের কারণে উৎপাদিত ফসলের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। শেখ হাসিনার প্রকট দৃষ্টি গরিব মানুষের দিকে। কিন্তু শ্রেণিস্বার্থে সচেতন ধনিক শ্রেণি সৃষ্ট সম্পদ এককভাবে উপভোগ করতে চায়। গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের কল্যাণের কথা তারা মোটেই ভাবে না। এদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে না পারলে, এদের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু শোষক শ্রেণির বঞ্চনা থেকে জনগণকে মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

দুর্নীতি আজ উন্নয়নের প্রতিপক্ষ। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে, উন্নয়ন তৎপরতার গতি থমকে যাবে। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে। দুর্নীতি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। দেশ ও জাতির চরম শত্রু দুর্নীতিবাজরা। আইনের প্রয়োগে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। শুধু বিরোধী দল নয়, সরকারি দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সৎ, সাহসী ও কঠোর পরিশ্রমী। এর আগেই তিনি বিশ্বের সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস একমাত্র শেখ হাসিনাই পারেন এটা নিশ্চিত করতে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
উন্নয়ন,দুর্নীতি,কলাম,মতামত
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist