আলমগীর খান

  ০৩ এপ্রিল, ২০১৮

‘এ কোয়ার্টার মাইল কান্ট্রি’

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার স্বীকৃতি পাওয়ার ঘটনাকে বাংলাদেশ বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপন করল কদিন আগে। উদযাপনের মূল উদ্যোক্তা ছিল সরকার। এ স্বীকৃতি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধির পরিচয় বহন করে। দেশের সব মানুষের অনুভূতি অবশ্য একরূপ হওয়ার কথা না। দেশ উন্নয়নের স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ যে দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি পেয়েছে, তা নয়। এই উদযাপন তাই দেশের বহু মানুষের মনে দাগ কাটেনি। বেশির ভাগ মানুষ উন্নয়নকে কোনো আন্তর্জাতিক শক্তি বা এজেন্সির কাছ থেকে সনদপত্র পাওয়া হিসেবে দেখে না। তারা নিজ ও নিকটজনের জীবন দিয়ে তা দেখে ও বিচার করে। তা ছাড়া উন্নয়নকে সবাই এক চোখেও দেখে না, একেকজনের পরিমাপক একেক রকম।

বেশির ভাগ মানুষের কাছে উন্নয়ন হচ্ছে মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণের সক্ষমতা অর্জন। মৌলিক চাহিদা শুধু ভাতকাপড় নয়, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ইত্যাদিও। উন্নতির ধারণার সঙ্গে আরো অনেক কিছু জড়িত। সরকার উন্নতি যে রকম সোজাসাপ্টা শতকরা হিসাব দিয়ে মাপে, সব মানুষ তা করে না, তারা নিজ জীবনে তার সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিফলন দেখতে চায়, কারো কাছ থেকে এ ব্যাপারে সার্টিফিকেটের অপেক্ষা করে না।

তবু এ কথা মানতেই হবে, স্বাধীনতার সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। অনেকের প্রশ্ন অন্য জায়গায়, বাংলাদেশের এ উন্নতি অর্জন করতে যে দীর্ঘ সময় লেগেছে তা নিয়ে। দেশ কি আরো আগেই এ পর্যায়ে পৌঁছার কথা নয়? আর এই উন্নতি গুটিকয় মানুষের, না সবার, সে প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নের ফসলের সমবণ্টন না হোক, সাম্যবণ্টন হয়েছে কি? উন্নয়ন যদি মানুষে মানুষে বৈষম্য ও ভেদাভেদ বাড়িয়ে থাকে, তবে তার কুফলও অনেক।

মানুষে মানুষে প্রেম, বিশ্বাস, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা বেড়েছে, নাকি হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতারণা, সহিংসতা ইত্যাদি বেড়েছে তাও দেখার বিষয়। উন্নয়ন যাতে সার্বিক আর সুফল যাতে সর্বজনীন হয়, এখন সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। কিন্তু এ কথা সত্য, বাংলাদেশ এত দিনে হেনরি কিসিঞ্জারের মুখে চুনকালি মেখেছে, যে এক দিন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অবজ্ঞা করেছিল। এবার বাংলাদেশের এ সাফল্য উদযাপনকালে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে লেখক এবং উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ শাহজাহান ভূঁইয়া এ ব্যাপারে সুন্দরভাবে বলেন, ‘বাংলাদেশের সাফল্য কিসিঞ্জারের দেওয়া অপবাদকে অতীতের অতল গর্ভে বিলীন করেছে।’

অনেকের ধারণা, কিসিঞ্জারের অহমিকা আরো আগেই মুখ থুবড়ে পড়ত যদি বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের খপ্পরে না পড়ত। ঋণদাতাদের অর্থসাহায্য আমাদের পিছিয়ে রেখেছে। স্বাধীন হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমেদ যেভাবে বিদেশি সাহায্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যদি সেই ধারা বজায় রাখা সম্ভব হতো, দেশের সত্যিকার উন্নতি সম্ভব হতো। বহুল প্রচারিত প্রকাশ্য সাহায্যের পেছন দিয়ে অনেক অর্থ বেরিয়ে গেছে। আর এসব সাহায্যের খুব কমই মানুষের কাজে লেগেছে। যাদের জন্য এসব ঋণ ও সাহায্য এসেছে, তাদের কাছে হয়তো ছিটেফোঁটা পৌঁছেছে। বেশির ভাগই কর্তাদের মাইনে, ব্যবস্থাপনা খরচ ও চুরির খাতে ব্যয় হয়েছে। এসব সাহায্য দেশে ও সমাজে দুর্নীতি ছড়ানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

সাহায্য আনার জন্য দেশের একটা গোষ্ঠী সব সময় দুর্যোগকে ও এর ফলে মানুষের দুর্দশাকে মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করেছে। প্রধান ক্ষতি হয়েছে দরিদ্র মানুষের আত্মমর্যাদার। বিশ্বের চোখে বাংলাদেশের পরিশ্রমী কষ্টসহিষ্ণু দরিদ্র মানুষ হেয় হয়েছে তাদের অজান্তেই। আর লাভ হয়েছে অন্য একটা গোষ্ঠীর। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে যে বন্যা হয়েছে, তা সামাল দিতে তাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। খোদ আমেরিকায় বিশেষজ্ঞরা বলাবলি করেছেন বন্যার মতো দুর্যোগকে মোকাবিলা করায় বাংলাদেশের মানুষের দক্ষতার কথা।

এখন উন্নয়নশীল দেশের সার্টিফিকেট লাভের কারণে বিদেশি সাহায্য কমে যাবে বলে অনেকে আক্ষেপ করছেন। আসলে এতে সাময়িক কষ্ট হলেও আখেরে মানুষের লাভ হবে। বিদেশি সাহায্যে যাদের গাড়িবাড়ি হতো, তাদের ক্ষতি হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষ মুখ থুবড়ে পড়বে না। বাংলাদেশ যে বিদেশি সাহায্য ছাড়াও পদ্মা সেতুর মতো একটা বিরাট নির্মাণকাজে হাত দিতে পারে, সে প্রমাণ ইতোমধ্যে রেখেছে। আর এই কিছুদিন আগে আমাদের দেশ ও মানুষ দেখাল আরেক সাহস— তারা গণহত্যার শিকার হয়ে মাতৃভূমি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিল।

পৃথিবীর বহু দেশ এখন শরণার্থী-সমস্যায় জর্জরিত। অনেক উন্নত দেশের সরকারও শরণার্থীদের রাখতে চাচ্ছে না। অথচ অনেক দেশের মানুষ শরণার্থী হয়েছে উন্নত দেশের সরকারগুলোর নেওয়া বিভিন্ন অন্যায় ও অমানবিক পদক্ষেপের কারণে। এখন তারা রাজনীতির গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক দেশে সরকার টালমাটাল হয়ে পড়ছে, ক্ষমতার হাত বদল হচ্ছে, যে ক্ষেত্রে শরণার্থী-সমস্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। শরণার্থীর কথা শুনলে অনেক ধনী দেশের আত্মাও শুকিয়ে ছোট হয়ে যায়। সেই দাম্ভিক কুচক্রি কিসিঞ্জারের দেশ যুক্তরাষ্ট্রও এখন সেখান থেকে অভিবাসীদের বিতাড়নের পাঁয়তারা করছে। তাহলে ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র কেমন ঝুড়ি কিসিঞ্জার সাহেব আমাদের বলবেন কি? অনেক দেশই দেখা যাচ্ছে অর্থসম্পদে অনেক ধনী হলেও মনের দিক থেকে নিতান্ত দরিদ্র।

বাংলাদেশ ও তার মানুষ সে ক্ষেত্রে ভিন্ন পরিচয় দিতে পেরেছে। ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে এ দেশের সরকার পিছপা হয়নি। যদিও আমাদের নিজেদের সমস্যার অন্ত নেই, তবু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সরকার তাদের থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয়, এই মানবতার সংকটের প্রতি সরকার বিশ্বের শক্তিশালী দেশ ও সংস্থাসমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের এই সাহসী ভূমিকায় মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী সরকার হোঁচট খেয়েছে। মানবতার সংকটকে সামরিক ঝামেলায় পর্যবসিত করার জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নানা রকম উসকানিমূলক আচরণ করেছে। কিন্তু বিপন্ন মানবতার প্রতি এ দেশের মানুষ ও সরকার যে হাত প্রসারিত করেছে, কোনো কিছুতে তা গুটিয়ে নেয়নি। এখন বাংলাদেশ নিতান্তই সাহায্যপ্রার্থী দেশের পরিচয় থেকে ভিন্ন আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের এই পরিচয়কেই প্রধান করে তুলেছে নোমান রবিনের সাম্প্রতিক নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘এ কোয়ার্টার মাইল কান্ট্রি’, যা দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরকে বোঝানো হয়েছে। হিজড়াদের সমস্যা নিয়ে ‘কমন জেন্ডার’ ছবি করে চলচ্চিত্রকার রবিন আগেই খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার বর্তমান ছবিটি আন্তর্জাতিক কান উৎসবের ৭১তম আসরে শর্টফিল্ম কর্নারে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এটি একটি গৌরব, তবে এটি মূল বিষয় না। ছবিটির মূল উদ্দেশ্য বিপন্ন মানবতার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সাহসকে তুলে ধরা ও মানবতার সংকট নিরসনে এ দেশের ভূমিকার কথা বিশ্ববাসীকে জানানো।

‘এ কোয়ার্টার মাইল কান্ট্রি’ ছবিটি তৈরির উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিচালক নোমান রবিনের বক্তব্য : ‘এটা জিও পলিটিক্যাল ফিল্ম। ... আমাদের জার্মানির মতো সামর্থ্য নেই কিন্তু সাহস আছে, মানসিক শক্তি আছে—এ বিষয়টাকেই মূলত সারা পৃথিবীতে ফোকাস করা আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা এবার দারিদ্র্য বিক্রি নয়, সাহস বিক্রি করতে যাচ্ছি। আমাদের সাহস আছে, এটা পৃথিবীকে দেখানোই এ ফিল্মের মূল উদ্দেশ্য। এই ফিল্মের মাধ্যমে অ্যাওয়ার্ড পাওয়াটা আমাদের টার্গেট না, মূল টার্গেট হলো ৭টা উপমহাদেশে এই ফিল্মটাকে ছড়িয়ে দেওয়া। যত বেশি এই ফিল্মটা ছড়িয়ে যাবে, যত বেশি মানুষকে আমাদের গ্লোরি দেখানো যাবে, তত আমি আসলে সেটিসফাইড হব।’

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রোহিঙ্গা,নোমান রবিন,শরণার্থী-সমস্যা,স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist