আর কে চৌধুরী
যানজট ও মশক কাহিনি
রাজধানীর যানজট কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। যানজট কমানোর বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগ তেমন কোনো কাজেই আসছে না। নিকট ভবিষ্যতে এ যানজট কমবে, এমন কোনো ধারণাও পাওয়া যাচ্ছে না। বরং বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, দ্রুত পরিকল্পিত উদ্যোগ না নেওয়া হলে ২০৩৫ সাল নাগাদ যানজট বর্তমানের দ্বিগুণ হবে।
ঢাকায় রাস্তা বাড়ছে না। অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা নগরীতে এমনভাবে ভবন তৈরি হয়েছে, যেখানে রাস্তা বাড়ানোর সুযোগও কম। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঢাকার রাস্তায় বড়জোর ২ লাখ ১৬ হাজার গাড়ি চলাচল করতে পারে। বাস্তবে চলছে তার চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বেশি। ফলে যানজটে নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে। তারপরও রাজধানীতে প্রতিদিন ৩৭১টি নতুন গাড়ি নামছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে গাড়ি নেমেছে ১ লাখ ১৪ হাজার ২৭১টি, যার অধিকাংশই ব্যক্তিগত গাড়ি।
২০১০ সালে যেখানে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ছিল ছয় লাখের কম, ২০১৭ সালের অক্টোবরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ লাখে। আবার অ্যাপভিত্তিক গাড়ি চলাচল শুরু হওয়ায় গাড়িগুলোর ট্রিপ সংখ্যাও অনেক গুণে বেড়ে গেছে। অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ি সংগ্রহে আরো বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। বাইরে থেকেও প্রতিদিন অনেক গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করছে। তাই অল্প কিছু উড়াল সড়ক বাড়লেও তা যানজট কমানোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি। অন্যদিকে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা হু হু করে বাড়লেও বাড়ছে না গণপরিবহন। পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাসেই চলছে বেশির ভাগ মানুষের অতি কষ্টের চলাচল।
শৃঙ্খলাহীনতাও রাজধানীতে যানজটের একটি বড় কারণ। বাস-মিনিবাসগুলো যেখানে-সেখানে দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। প্রাইভেট কার, ট্রাক, ভ্যান ইত্যাদি যত্রতত্র রাস্তার ওপরে পার্কিং করে রাখা হয়। একই সড়কে ধীরগতির ও দ্রুতগতির যানবাহন চলায় পুরো রাস্তায় গতি কমে যায়। অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজের জন্যও রাস্তায় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়। ফুটপাতগুলো হকার ও দোকান মালিকদের দখলে চলে যাওয়ায় পথচারীরা বাধ্য হয় রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে। এতেও গাড়ি চলাচলের রাস্তা সংকুচিত হয়ে যায়। আর বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পারাপার যানবাহনের গতি কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রচুর দুর্ঘটনাও ঘটায়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনার উল্লেখযোগ্য কোনো প্রচেষ্টাই দেখা যায় না। পুরোনো ও ফিটনেসহীন গাড়িও যত্রতত্র নষ্ট হয়ে যানজটের সৃষ্টি করে।
বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নয়, ঢাকায় যানজটের দ্রুত বা আশু সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে জরুরি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। ঢাকায় প্রতিনিয়ত মানুষ বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে। এখনই উদ্যোগ না নিলে পাঁচ-দশ বছর পরে যে অবস্থা হবে, তাতে সমাধানের কথা চিন্তা করাও হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে। প্রয়োজনে নতুন ব্যক্তিগত গাড়ি নামানোকে নিরুৎসাহী করতে হবে। বিশেষ লেন করে গণপরিবহনের চলাচল সহজ করতে হবে। রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মশা মারতে কামান দাগার কথা বহুল প্রচলিত। কিন্তু কামানের গোলার গতিতে ছুটে চলার ক্ষমতা রাখে যে আকাশযান তাকে যদি কুপোকাত করে মশা তাহলে! ঘটনাটি কিছুটা সে রকমই বটে। উড্ডয়নোন্মুখ বিমানের গতি থামিয়ে তাকে ‘ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়নে’ বাধ্য করেছে মশককুল। আর সেটা আমাদের দেশের প্রধান বিমানবন্দরেই। সম্ভবত এটি একটি বিশ্বরেকর্ড। এমন ঘটনার কথা এর আগে কেউ শুনেছে বলে জানা যায় না।
দীর্ঘদিন পাখির আক্রমণ থেকে মোটামুটি নিরাপদে ছিল হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তাতে পাইলটরা কিছুদিন শান্তিতে থাকলেও এবার বেঁকে বসেছে মশা। পাখির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মশারাও যেন একযোগে আক্রমণে নেমেছে। যে কারণে সম্প্রতি শাহজালাল বিমানবন্দরে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট প্রায় দুই ঘণ্টা বিলম্বের শিকার হয়।
আপাত দৃষ্টিতে হাসির উদ্রেককারী ঘটনা মনে হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে করুণ রস ও নিদারুণ বিরক্তি। মশা কিনা করতে পারে! ক্ষুদ্র প্রাণী সৃষ্টির সেরা জীবের প্রাণ ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলতে পারে। গত বর্ষা মৌসুমের কথা কারো ভোলার কথা নয়, বিশেষ করে ঢাকাবাসীর হাড়ে হাড়ে জমা রয়েছে সেই দুঃসহ স্মৃতি। এর আগে ডেঙ্গু রোগের কারণে ভয়কর জীব হয়ে উঠেছিল মশা। গত বছর হয়ে উঠল চিকুনগুনিয়া রোগের শক্তিধর বাহক। ঢাকার প্রতিটি পরিবার না হলেও প্রতি তিনটি পরিবারের মধ্যে কেউ না কেউ ওই অবাক করা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। আর পরিবারের একজন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া মানে পরিবারের অন্য কারো একই রোগে সংক্রমিত হওয়ার মহাঝুঁকি তৈরি হয়। অবাক করা ব্যাধি বলার কারণ হলো—এতে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের প্রতিটি অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা তৈরি হয়, সে সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা—এ রোগ ও তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর অল্প কয়েক দিনে ভালো হয়ে গেলেও তিন থেকে ছয় মাস, অনেক সময় পুরো এক বছর রোগী দেহের ব্যথা-বেদনায় ভুগে থাকেন।
যা হোক, ভাগ্যিস মশা বিমানকে ‘ভূপতিত’ করে রেখেছিল অনেকটা সময়। আর সেই সুবাদে সংবাদটি বিশেষ গুরুত্বসহকারে পরিবেশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। এতে একটা লাভ হতে পারে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। মশক নিধন যে সংস্থাটির দায়িত্ব ওই ঘটনার পর তারা নড়েচড়ে বসতে পারে। শুরু হোক মশক নিধন। শুধু বিমানবন্দর এলাকার আশপাশে নয়, গোটা রাজধানীতেই। আগেভাগে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রতিরোধ কার্যক্রমে গতি আসুক। শাবাশ মশা, তোমরা আক্রমণ না শানালে সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের ঘুম ভাঙার যে সম্ভাবনাই ছিল না।
পিডিএসও/হেলাল