আবু তাহের

  ১১ জানুয়ারি, ২০১৮

পর্যালোচনা

বেকারত্ব আর কতকাল

বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত বেকার আছে কেবল আফগানিস্তানে, ৬৫ শতাংশ। বছরখানেক আগের জরিপ। সর্বশেষ আদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০১১ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ জন। ২০১১ সালের ১৫-১৯ মার্চ আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

২০২১ সালে বাংলাদেশে ষষ্ঠ আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা আছে। ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৫-১৬-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট বেকারের সংখ্যা বর্তমানে ২৫ লাখ ৮৭ হাজার। নারী ও পুরুষ উভয়েই ১৩ লাখ করে বেকার। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০১২ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন করে ২২ লাখ কর্মক্ষম শিক্ষিত মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু কাজ পায় ৭ লাখ, বাকি ১৫ লাখ থাকে বেকার। এর মধ্যে উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন তারাও রয়েছেন।

চাকরির বাজার দারুণ মন্দা যাচ্ছে। বছরখানেক ধরে দেশে বিনিয়োগ কম হওয়ায় শিল্প খাতে নতুন প্রকল্প হচ্ছে কম। সরকারি খাতে বড় কিছু বিনিয়োগ হলেও এতে কর্মসংস্থানে গতি পাচ্ছে না। এ ছাড়া রয়েছে দক্ষ জনবলের অভাব। সব মিলিয়ে চাকরির বাজার ভালো যাচ্ছে না। এ বছরের শেষদিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ওই নির্বাচনের কারণে এ বছর বিনিয়োগের চাকায় হাওয়া না লাগার সম্ভাবনাই বেশি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) তথ্য মতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। সংস্থাটির মতে, বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম। এ ছাড়া ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এ দেশে বেকারের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। তার মধ্যে শিক্ষিত বেকার হচ্ছে ২ কোটি ২০ লাখ। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্য মতে, দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ৯৫ সালে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী বেকার যুবকের সংখ্যা ছিল ২৯ লাখ। কিন্তু ২০০৫ থেকে ১০ সালের মধ্যে তা প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি ৩২ লাখে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি বেকার চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা। আর বেকারত্বের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা। চিকিৎসকদের বেকার থাকার কোনো সুযোগ নেই। কারণ তারা রোগী দেখেন। আর প্রকৌশলীদের কাজ হলো চাকরিনির্ভর। কিন্তু তার পরেও চিকিৎসকদের মধ্য থেকে মহিলা চিকিৎসকদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। তাদের বেকারত্বের হার পুরুষদের তুলনায় বেশি।

যদি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের এই অবস্থা হয় তবে মাদরাসাশিক্ষায় শিক্ষিতদের কী অবস্থা? যদিও একটা খবর অনেক দিন ধরেই প্রচলিত, মাদরাসাশিক্ষা গ্রহণ করে এক বিশাল জনগোষ্ঠী বেকার হচ্ছে কিংবা এই শিক্ষাব্যবস্থা ভবিষ্যতে কী দেবে শিক্ষার্থীদের? কারণ এই শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবমুখী এবং আধুনিক নয়। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই শিক্ষায় শিক্ষিত যাদের আমরা হুজুর কিংবা আলেম যেই নামেই সম্বোধন করি না কেন, বেশির ভাগ লোক বাস্তবে বেকার জীবনযাপন করছে না। এর তেমন কে নো উল্লেখযোগ্য সংখ্যাও নেই এবং উপরোল্লিখিত রিপোর্টেও এই ধরনের চিত্র পাওয়া যায়।

কারণ বাস্তবে তারা কোনো না কোনো মসজিদ, মাদরাসা কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত অবস্থায় আছেন। যদিও অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবনযাত্রার মান তেমন উঁচু নয়, তবু বেকার নন তারা। এটা সত্যি, বেকার জীবন একটা অভিশাপ। অন্যের বোঝা হয়ে ঘুরে বেড়ানো, সত্যিই অনেক লাঞ্ছনার। তার থেকে এটা ভালো নয় যে কিছুটা নিচু মানের জীবনযাত্রা হলেও বেকার না থাকা। তার মানে এই নয় যে, আমি সবাইকে এখন মাদরাসাশিক্ষায় শিক্ষিত হতে বলব। স্রেফ বাস্তব চিত্রটা তুলে ধরা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বর্তমান মাদরাসাশিক্ষাকে একটা মানসম্মত পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এটি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। আশাব্যঞ্জক বিষয়। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য কাজ হচ্ছে।

কিন্তু বেকারত্বের কারণ কি শিক্ষা ব্যবস্থা? দেশের মোট আটটি খাতে চাহিদার তুলনায় বর্তমানে শ্রমিক কম রয়েছে ১৭ লাখ ২৭ হাজারের বেশি। সঙ্গে রয়েছে মধ্যমসারির কর্মকর্তার সংকটও। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এ হিসাবে ২ কোটি ২ লাখ লোক বেকার। এর ওপর প্রতি বছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। তাদের বড় অংশই থাকছে বেকার। আইএলওর হিসেবে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর ২০ লাখ লোক প্রবেশ করছে। এর মধ্যে কারিগরিভাবে দক্ষ জনবল বের হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ২০০। বাকি সবই অদক্ষ। আর তাদের অনেকের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকলেও কারিগরি দক্ষতা নেই। ফলে অনেকেই চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। দেশের শ্রমবাজারের বড় অংশই কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোকদের দখলে।

বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অশিক্ষিত বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশ কম। ১০০ অশিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে মাত্র তিনজনেরও কম বেকার থাকেন। বিবিএসের এই হার ২ দশমিক ৮২ জন। আবার মাদরাসায় শিক্ষিত লোকরাও বেকার নন। তাহলে কোন সে বিষয় যা বেকরত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?

উচ্চশিক্ষায় সনদ পাওয়া আমাদের শিক্ষার্থীরা শিল্পের উৎপাদন, বিপণন পর্যায়ে চাকরি করতে আগ্রহী নয়। তাদের আগ্রহ সরকারি চাকরি, ব্যাংক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিলের কাজ। কিন্তু চাকরির বাজারের পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশে একটি শিল্প স্থাপিত হলে সেখানে কর্মকর্তা পর্যায়ে যদি ১০ জন লোক নিয়োগের দরকার হয়, দক্ষ, আধাদক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের দরকার হয় শতাধিক। আর উচ্চাকাঙ্কার কারণে উচ্চশিক্ষিতরা কর্মকর্তা পদে চাকরি না পেয়ে বেকার থাকছে। শিল্প কারখানাগুলো ভুগছে শ্রমিক সংকটে।

উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিলসিতা এবং কোনো কাজকে ছোট মনে করা আমাদের করে দিচ্ছে বেকার। বাড়ছে অস্থিরতা, ক্লেশ আর বোঝা। যেখানে অশিক্ষিত লোকরা অনায়াসে যেকোনো পেশায় অনায়াসে নিজেকে নিযুক্ত হতে পারছে সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, যারা কমপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে তারা থেকে শুরু করে স্নাতক ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরা এই ডিগ্রির কারণে যেকোনো পেশায় নিযুক্ত হতে পারছেন না। এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় তারা প্রায়ই ভুগেন। এ বিষয়ে বিবিএসের সাবেক পরিচালক (শিল্প ও শ্রম শাখা) শামসুল আলম বলেছেন, চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলীরা নিজেদের কর্মজীবন নিয়ে সন্তুষ্ট না থাকায় জরিপের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সময় অনেকেই নিজেদের বেকার বলে দাবি করছেন। তার এ কথার মধ্যেও উপরোক্ত যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় যে, অধিকাংশ লোকই উচ্চাশা করে। যার ফলে অনেকে স্বেচ্ছায় বেকার দাবি করছেন আবার অনেকেই স্বেচ্ছায় বেকার জীবনযাপন করছেন।

যার শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি, তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যারা দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর যারা অনার্স-মাস্টার্স পাস করেছেন, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ।

২০১৭ সালে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার বেড়ে ২০ শতাংশ পেরিয়ে যাওয়ার কথা। দেশের প্রধান শ্রমশক্তি বলে মনে করা হয় ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীকে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশই কাজে অদক্ষ। সংখ্যায় তারা এক কোটিরও বেশি।

আর এ থেকে অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির সূচনা হয়। সাধারণ জীবনযাপনে অনিচ্ছা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দুর্নীতির দিকে ঠেলে দেয়। শুধু একটু সদিচ্ছার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই এই বেকারত্ব ও দুর্নীতি কমানো সম্ভব। দেশ হয়ে উঠতে পারে আরো স্বাবলম্বী। এক বিশাল দক্ষ জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে আমরা হয়ে উঠতে পারি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বেকার,বেকারত্ব,আদমশুমারি,চাকরি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist