ইয়াসমীন রীমা

  ০২ জানুয়ারি, ২০১৮

লাল রক্তে কালো ব্যবসা

পেশাদার রক্তদাতা মান্নান হায়দার। দুদিন আগে রক্ত দিয়ে পেয়েছিলেন এক হাজার টাকা। আবার তিনি রক্ত দিতে এসেছেন। কুমিল্লা মেডিক্যালে একজন দুর্ঘটনার রোগী এসেছেন। তার জন্য রক্ত প্রয়োজন। এজন্য সেন্টার থেকে তার ডাক এসেছে। জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, কী করব রোগীর লোকজন রক্ত পাচ্ছে না। তাই আমার ডাক পড়েছে।

অন্য রক্তদাতা মোতালেব বলেছেন, তার রক্তের গ্রুপ ‘ও-নেগেটিভ’। এ গ্রুপের রক্ত খুব কম পাওয়া যায়। তিনি দুই হাজার টাকার কমে রক্ত দেন না। মাসে কয়েকবার তাকে রক্ত দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘রোগীর লোকজন আমাদের দেখেন না। শুধু রক্ত নিয়ে যান। আমরা গোপনে রক্ত দিয়ে যাই।’ অনুসন্ধান করে জানা যায়, সরকারিভাবে এক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ ও স্কিনিং করতে খরচ হয় ২৫০ টাকা। অথচ এই রক্ত বেচাকেনা হয় তিন থেকে চার হাজার টাকায়। অন্যদিকে পেশাদার রক্তদাতার কাছে থেকে মাত্র এক থেকে দুই হাজার টাকায় পাওয়া যায় এক ব্যাগ রক্ত।

রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ব্লাড ব্যাংক। সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবে বেশিরভাগ ব্লাড ব্যাংকেই স্কিনিং ও ক্রস ম্যাচিং ছাড়াই অনিরাপদ রক্তের কেনাবেচা চলছে। এগুলোর ওপর সরকারে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার নিয়মনীতির উল্লেখ আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই এসব রক্তকেন্দ্র নীতিমালা অমান্য করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র মতে, জনবল সংকটের কারণে তারা ব্লাড ব্যাংকগুলোতে তদারকি করতে পারে না। প্রধান কার্যালয়ে জনবল থাকলেও তা চাহিদার চেয়ে কম। জেলা অফিসগুলোতে জনবলের সংখ্যা খুবই কম। যে কারণে তারা তদারকি করতে পারছে না। আবার অনুমোদন ছাড়া যেসব ব্লাড ব্যাংক পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলো দেখা তাদের বিষয় নয়। সেগুলো দেখছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তারা মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। এছাড়া র‌্যাবের আওতায় একটি মেডিক্যাল ইউনিট গঠন করা হয়েছে। তারা গোপন সূত্রে খবর সংগ্রহ করে বেআইনি ব্লাড ব্যাংকে অভিযান চালায়। তবে খুবই সীমিত আকারে।

রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলো বা ব্লাড ব্যাংকগুলোতে সংগৃহীত প্রায় সাড়ে ছেচল্লিশ হাজার ইউনিট রক্তে নানা জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে এইডস, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইসি-বি, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়া। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, অনিরাপদ রক্ত গ্রহণের কারণে একজনের জটিল রোগ আরেকজনের শরীরে সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। রক্তদান একটি মহৎ সেবা। কিন্তু অনিরাপদ রক্তই আবার মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে।

হেলথ বুলেটিন ২০১৪-এ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, গত ২০১৩ সালে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৪ ইউনিট রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪০ ইউনিটে এইচআইভি পজিটিভ, ৩৬ হাজার ২৯১ ইউনিটে হেপাটাইটিস বি পজিটিভ, ৪ হাজার ৭০৬ ইউনিটে হেপাটাইটিস সি পজিটিভ, ৩ হাজার ৯৫০ ইউনিটে সিফিলিস ও ১ হাজার ৩৪৪ ইউনিট রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ধরা পড়ে। ২০১৩ সালে পরীক্ষা করা রক্তের মধ্যে ক্ষতিকর জীবাণুযুক্ত রক্তের পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৫৯১ ইউনিট-যা ২০১২ সালের তুলনায় প্রায় সাত গুণ বেশি। ২০১৪ সালেও প্রায় ৪৫ হাজার ইউনিট রক্তে বিভিন্ন জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। দেশের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলোর ওপর দু’বছর ধরে গবেষণা চালিয়েছে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই চলছে শতকরা ৮১ ভাগ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ব্যক্তিমালিকাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলো অবাণিজ্যিক বেসরকারি উদ্যোগ।

গবেষণায় তালিকাভুক্ত ২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র সাতটির কাছে রক্তের বিভিন্ন উপাদান পৃথকীকরণের জন্য যথাযোগ্য ব্যবস্থা রয়েছে। আর স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিরাপদ রক্তপরিসঞ্চালন কর্মসূচিতে (এসবিটিপি) তালিকাভুক্ত নয়, এমন সব প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত কর্মীর সংখ্যা সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় শতকরা ৬২ ভাগ কম রয়েছে। রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে রক্তদাতা নির্বাচন ও উপযোগিতা নিশ্চিতকরণ, রক্ত সংগ্রহ ও পরীক্ষা, দাতা-গ্রহীতা মেলানো, পরিসঞ্চালন ও রক্ত মজুদ করা, কর্মী প্রশিক্ষণ, শরীর ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত করণীয় উপকরণ ব্যবহার এবং তার পরিচর্যা-এসব বিষয়ের ওপর লক্ষ্য রাখার কথা রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন কেন্দ্রগুলোতে এবং কয়েকটি সরকারি কেন্দ্রেও এই নির্দেশনার কপি পাওয়া যায়নি। শুধু কর্মীরা নন, কেন্দ্রগুলোর প্রধানরাও রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ক বিভিন্ন নীতিমালা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না। শতকরা ৪৭ ভাগ কেন্দ্রে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই রক্ত পরিসঞ্চালনের কাজ চলে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ছয় লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। সংগৃহীত রক্তের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

রাজধানীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় সরকারি ও বেসরকারি কয়েকটি ব্লাড ব্যাংকে অনুসন্ধানে জানা যায়, অধিকাংশ ব্লাড ব্যাংকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার নেই। এসব ব্লাড ব্যাংকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত পাঁচটি ঘাতক ব্যাধির পরীক্ষা করা হয় না এবং তারা স্টেরিলিটি (সংক্রমণ রোধকারী ব্যবস্থা) মেনে চলে না। ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর ব্লাড ট্রান্সমিশনের সংজ্ঞা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিদের্শ মতে, নিরাপদ রক্তের জন্য একজন রক্তদাতাকে কমপক্ষে পাঁচটি রক্তবাহিত ঘাতক রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হয়।

এগুলো হলো- হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি এইচআইভি/এইডস, ম্যালোরিয়া ও সিফিলিস। তারা রক্তদাতা নির্বাচনের পূর্বশর্তও মানে না। নেই শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, নেই পোস্ট ডোনেশন রুম, পরিবেশও নোংরা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী রক্ত সংগ্রহের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে কর্মকর্তা বা সহকারী সার্বক্ষণিক থাকতে হবে। বিধি অনুযায়ী রক্ত-সংগ্রহ ও রক্তের প্রসেসিং, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সংরক্ষণ সরবরাহ বা বিতরণের জন্য প্রত্যেক রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে ওই কেন্দ্রের রক্ত সংগ্রহের ইউনিটের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে কর্মকর্তা ও অফিস স্টাফ সার্বক্ষণিকভাবে থাকতে হবে। বিধি অনুযায়ী যেসব কেন্দ্রে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ ইউনিট বা বছরে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার ইউনিট বা বছরে হাজার থেকে ৫ হাজার ইউনিট রক্ত সংগৃহীত হয়, সেখানে রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ একজন (সার্বক্ষণিক/পার্টটাইম) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার/মেডিক্যাল অফিসার দুজন, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) তিনজন, কাউন্সিলর একজন, রেজিস্টার্ড নার্স দুজন, ল্যাবরেটরি অ্যাটেনডেন্ট চারজন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা একজন, অফিস স্টাফ দুজন। আর যেসব কেন্দ্রে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ ইউনিট বা বছরে ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার ইউনিট রক্ত সংগৃহীত হয়, সেসব স্থানে যথাক্রমে তিনজন, চারজন, দুজন, তিনজন, তিনজন, একজন, দুজন এবং টেকনিক্যাল সুপারভাইজার একজন। এছাড়া বেসরকারি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সর্বনিম্ন ১০০ স্কয়ার মিটার এবং রক্তের উপাদান তৈরির জন্য অতিরিক্ত ৫০ স্কয়ার মিটার স্থানের সংস্থান থাকতে হলেও মনিটরিং কামিটির গাফিলতির কারণে ছোট্ট পরিসরেই গড়ে উঠেছে এসব ব্লাড ব্যাংক।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক পরিপত্র অনুযায়ী রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের সরকারি ও বেসরকারি ইউজার ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিপত্র অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডের রোগীদের গ্রুপিং ও ক্রসম্যাচিং পরীক্ষা বিনামূল্যে আর রক্ত বা রক্ত উপাদানের জন্য স্ক্রিনিং ফি ২৫০ টাকা প্রতি ব্যাগ, পেয়িং বেডের জন্য রক্ত বা রক্ত উপাদানের গ্রুপিং, ক্রসম্যাচিং ও স্ক্রিনিং ৩৫০ টাকা প্রতিব্যাগ, কেবিনের রোগীদের জন্য রক্ত বা রক্ত উপাদানের গ্রুপিং ক্রসম্যাচিং ও স্ক্রিনিং ৫০০ টাকা প্রতিব্যাগ। বেসরকারি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে এই ফির হার হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডের রোগীর জন্য রক্ত বা রক্ত উপাদানের গ্রুপিং, ক্রসম্যাচিং ও স্ক্রিনিং ৪০০ টাকা প্রতি ব্যাগ, হাসপাতালের পেয়িং ওয়ার্ড, কেবিন ও ডে-কেয়ারের রোগীদের রক্ত বা রক্ত উপাদানের গ্রুপিং ক্রসম্যাচিং ও স্ক্রিনিং যথাক্রমে ৫০০, ৭০০, ৫০০ টাকা প্রতিব্যাগের জন্য। বিশেষজ্ঞ সেবা ফি ৫০০ টাকা। এছাড়াও পরিপত্রে সরকারি ও বেসরকারি রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের ৬৩টি আইটেমের ইউজার ফি নির্ধারণ করা হয়।

দেশে অবস্থিত প্রায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই একটি করে ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ ব্লাড ব্যাংকে ব্লাড আছে কি না জানতে চাইলে কবির নামে একজনের সাফ জবাব, ‘তাইলে আপনে খুঁইজা লন’। এদিকে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে বেশিরভাগ সময় রক্ত পাওয়া যায় না। দেশে বর্তমানে ২০৩টি সরকারি হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংকের কার্যক্রম চলছে। রাজধানীসহ সারা দেশের অনেক হাসপাতালেই ব্লাড ব্যাংক নেই। অথচ এসব হাসপাতালে অনেক জটিল রোগের অপারেশন হয়ে থাকে। ব্লাড ব্যাংক স্থাপনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তেমন আগ্রহী না হলেও আইসিইউ, সিসিইউ বা সিটি স্ক্যানের মতো ব্যয়বহুল খাতে তারা ঠিকই বিনিয়োগ করছে। বিনিয়োগ নেই শুধু রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে। যদিও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এটি একটি বিশেষ বিভাগ, যাকে বাদ দিয়ে শৈল্য চিকিৎসার কথা চিন্তাও করা যায় না, বরং মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। আর অযতœ অবহেলায় পরিচালিত হলে মারাত্মক ঘাতক রোগে দেশ সংক্রমিত হতে পারে। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান হওয়াটাই সবার জন্য মঙ্গল।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রক্ত দান,রক্তদাতা,ব্লাড ব্যাংক,রক্তের কেনাবেচা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist