পঞ্চানন মল্লিক
উদযাপন
থার্টিফার্স্ট নাইট
ইংরেজি বর্ষ গণনায় ৩১ ডিসেম্বর বছরের শেষ দিন। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটের সূচনালগ্নে নতুনের কেতন উড়িয়ে শুভসূচনা হয় ইংরেজি নববর্ষের। পুরোনো জীর্ণতা ও গ্লানি ভুলে নতুন সুখ, স্বপ্ন, সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার দীপ্ত প্রত্যয় ব্যক্ত হয় নতুনের বার্তায়। বাংলায় যেমন ১২ মাস, ইংরেজিতেও তেমনি জানুয়ারি থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাস। ডিসেম্বরের শেষ দিনটি ইংরেজরা পালন করেন থার্টিফার্স্ট নাইট হিসেবে। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে এদেশে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি দিন, তারিখ অনুসরণ করতে হয়।
স্বাভাবিক কারণেই ইংরেজি নববর্ষ আমাদের জীবনে এসে যায়। যদিও বাঙালির শাশ্বত প্রাণের উৎসব হচ্ছে ১ বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। তবু ইংরেজি নববর্ষ ও থার্টিফার্স্ট নাইটও আমাদের দেশে ঘটা করে পালিত হয়ে থাকে। স্থানে স্থানে ক্ষুদ্র প্যান্ডেল করে বিশেষ করে দেশের যুব সম্প্রদায় বা টিনএজদের দিনটি উদ্যাপনে বেশি উদ্যোগী হতে দেখা যায়। শামিয়ানা ও কাপড়ে নির্মিত ছোট প্যান্ডেল আর ব্যান্ডবক্সে গান বাজিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। দিনটি তাদের কাছে বেশ প্রিয় ও মজার। একপাশে চলে রান্নাবান্নার আয়োজন। উন্নত ভোজের আয়োজনে একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও থাকে। পাড়ার বন্ধু-বান্ধব বা কলেজের সহপাঠীরা মিলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মেতে ওঠে ভোজ ও সংগীতের মূর্ছনায়।
অনেকে বিভিন্ন ক্লাব বা রেস্টুরেন্টেও অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেন। নববর্ষ মানে নতুন বছরে নতুন করে পথচলার অনুপ্রেরণা। কবিতার ভাষায় বলতে গেলে, ‘একটি বছর বিদায় নিল আর নতুন বছর শুরু হলো।’ বিগত বছরে কী পেলাম আর কী পেলাম না, কী হারালাম আর কী হারালাম না-এই হিসাব না কষে অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে কিভাবে আগামী দিনগুলোকে আরো অর্থবহ করে তোলা যায়-এই চিন্তাই আমাদের করতে হবে। কথায় আছে শুরু ভালো যার শেষ ভালো তার। তাই এই দিনটি সুন্দরভাবে আমাদের শুরু করতে হবে। এই অনুষ্ঠান করতে গিয়ে যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু না ঘটে সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। খারাপ কিছু কারোই কাম্য নয়, তবু কখনো কখনো থার্টিফার্স্ট নাইটে বখাটেদের দ্বারা কিছু অশালীন আচরণের খবর আমাদের ব্যথিত করে। মন্দ লোকেরা অবশ্য সব জায়গাতেই সুযোগ খোঁজে। ওদের সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনে নিয়ন্ত্রিত অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে সবাইকে সতর্ক থেকে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আশা করি আমরা সবাই সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি উদ্যাপনে ব্রতী হব। কিন্তু শান্তি যেন আমাদের মাঝ থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন কোথাও কোনো অনুষ্ঠান হলে রেষারেষি, কোন্দল লেগে থাকে। পাড়ায় পাড়ায় একতার বদলে বিভক্তি লক্ষ করা যায়। আবার নানাজনের নানা মতে পন্ড হয় অনুষ্ঠানের পরিবেশ। আর নিজেদের মধ্যে এই বিভেদের সুযোগ নিয়ে ফায়দা লোটে এক ধরনের স্বার্থান্বেষী মতলববাজ। যারা দেশের ভালো চায় না তারা বিভিন্ন সুযোগে পানি ঘোলা করে সেই ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারের হীন প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এসব অনুষ্ঠান করার বেলায় এদের থেকে সতর্ক থাকাটাই সময়ের দাবি।
ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা, তাই এই ভাষার প্রতি সম্মান দেখাতে ‘ইংরেজি নববর্ষ’ আমরা উদ্যাপন করতেই পারি। কিন্তু এই অনুষ্ঠান করতে গিয়ে যেন আপত্তিকর কিছু না ঘটে সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, থার্টিফার্স্ট নাইট মানে উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, বরং সত্য ও সুন্দরের পথে আগামীকে বরণ করে নেওয়ার দিন। আগামী একটি বছর কিভাবে চলতে হবে, কিভাবে কাজ করলে আমরা আরো সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারব, করতে পারব দেশ ও দশের উন্নয়ন-তা এই দিন থেকেই আমাদের চিন্তার মাঝে সেই বীজ বপন করতে হবে।
দিবসের প্রথম সূর্য দেখে যেমন বোঝা যায় যে, পুরো দিনটা কেমন যাবে, ঠিক এই দিনে আমাদের কার্যকলাপ দেখে বোঝা যাবে আমরা কতটা অগ্রসর হতে পারব নতুন বছরে। গ্রাম-বাংলায় একটা প্রবাদ আছে-‘বছরের প্রথম দিন মিথ্যা না বললে অন্যান্য দিনও মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকা যাবে।’ প্রবাদটা কতটা সত্য তা জানি না। তবে বছরের প্রথম দিনটা যদি আমরা সুুষ্ঠু, সুন্দর ও মার্জিতভাবে কাটাতে পারি, তাহলে তার থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী দিনগুলোও করে তুলতে পারব সুন্দর ও আনন্দময়। এই দিনটিকে তাই আমাদের নিষ্কলুষ রাখতে চাই। বিশেষ করে অনুষ্ঠানের সময় যেন কোনো রকম উচ্ছৃঙ্খলতা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
আমরা বাঙালি। বিশ্বের মাঝে শান্তিপ্রিয় জাতি, তার পরিচয় এই অনুষ্ঠানেও আমাদের রাখতে হবে। ইংরেজি ভাষা ও জাতির প্রতি সম্মান দেখাতে আমরা এ অনুষ্ঠানটি উদ্যাপন করে থাকি। কিন্তু আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই যেন এই দিনটি উদ্যাপন করা হয়, সে বিষয়টি আমরা যেন ভুলে না যাই। পরিশেষে ইংরেজি নববর্ষ সবার জীবনে সুখ, শান্তি, আনন্দের এক সুমহান বার্তা ও আগামী দিনগুলোর জন্য সবার কল্যাণ বয়ে আনুক-এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
"পিডিএসও/তাজ