রিহাব মাহমুদ, কক্সবাজার থেকে ফিরে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৬নং তালিকাভুক্ত
কক্সবাজারে থার্টি ফাস্টকে ঘিরে সক্রিয় কথিত ইয়াবা ডন শাহজাহান
দিন দিন সর্বনাশা ইয়াবার প্রসার কতটা বেড়ে চলেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান বলে দেয়া সম্ভব নয়। প্রায় প্রতিদিনই শোনা যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবাসহ আটকের খবর। সারাদেশে যে কয় পিচ ইয়াবা বেচা-কেনা হয় সেই হিসেবের চেয়ে নামমাত্র সংখ্যক ইয়াবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। ইয়াবা বহনকারীরাই শুধু ধরা পড়ছে। এদের কারো শাস্তি হচ্ছে আবার কেউ কেউ পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ইয়াবা ব্যবসার রাঘব বোয়ালরা থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তাদের ব্যবসায়েও বিন্দু পরিমান ব্যাঘাত ঘটছে না। ইয়াবা নামক এই ভয়ংকর মাদকের কারবার করে রাতারাতি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন অনেকে।
সম্প্রতি কক্সবাজার গিয়ে ইয়াবা সংক্রান্ত কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকাগুলোতে এই ব্যবসা রমরমা। তেমনই কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ইয়াবার কারবার বেশি হয় বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাদকের শীর্ষ ব্যবসায়ীর তালিকায় এতদিন শুধু টেকনাফের এক সরকারদলীয় এমপির নাম বারবার শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু সেই ব্যক্তিকেও পিছনে ফেলে এবার উঠে এসেছে মো: শাহজাহান আনসারী নামের এক তরুণ ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম। কথিত সেই ইয়াবা ডন শাহজাহান আনসারীর খবর জানতে অনুসন্ধানে নামেন এই প্রতিবেদক।
জানা গেছে, কক্সবাজারের শাহজাহান আনসারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৬নং তালিকাভুক্ত। কক্সবাজার বাস টার্মিনাল সংলগ্ন তার রয়েছে বিলাশ বহুল বাড়ি। গোপন সূত্রে জানা গেছে, শাহজাহান ও তার ভাইরা একসময় ছিলেন পরিবহন শ্রমিক। ১০/১২ বছর ধরে পরিবহনে করে ইয়াবা শহরে আনতো আর বিভিন্ন স্থানে পরিবহনে পাচার করতো। আনা নেওয়ার ব্যবসা করতে করতে একসময় হয়ে ওঠেন ইয়াবা ডন।
শাহজাহান আনসারীর আছে ডায়মন্ড সিমেন্টের এজেন্সি ব্যবসা, প্রচুর মাইক্রোবাস, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে চলাচলকৃত অনেকগুলো বাস, কক্সবাজার শহরে অবস্থিত ২টি হোটেল। এমনকি ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে কয়েকটি ফ্ল্যাটবাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে প্রচুর জমির মালিকও তিনি।
জানা গেছে, কক্সবাজারের কলাতলী রোডে প্লট নং-৩৯, ব্লক-বি তে হোটেল লেগুনা বীচ এবং ১৫/বি, এফ-১৬, কলাতলী রোডে হোটেল জামান থেকে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সূত্র জানিয়েছে এ দুইটি হোটেলের মালিকও তিনি। জানা যায়, উক্ত হোটেলে বিভিন্ন ভাবে দেহব্যবসাও চালানো হয়।
মো: শাহজাহান আনসারী কক্সবাজারের বিভিন্ন তরুণ-তরুণীকে অর্থের লোভ দেখিয়ে ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত করছেন বলেও গোপন সূত্রে জানা গেছে। সামনে থার্টি ফাস্ট নাইট। এই সময়ে কক্সবাজারে লাখো পর্যটকের আগমন ঘটে। আর ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মূল টার্গেট থাকেও এই অন্তিম সময়টা।
গোপন সূত্রে জানা গেছে, থার্টি ফাস্ট নাইটকে সামনে রেখে মজুদ হচ্ছে কোটি টাকার ইয়াবা। ক্রেতা হবে পর্যটক। পর্যটকদের কাছে নারীর পাশাপাশি ইয়াবার কদরও থাকে। একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে সাড়ে ৪শ আবাসিক হোটেলে সরবরাহ হয় নারীর পাশাপাশি ইয়াবা বড়ি। পুরো শহরে প্রতিদিন পুড়ছে ২ থেকে ৩ লাখ পিচ ইয়াবা।
কক্সবাজারের কথিত ইয়াবা ব্যবসায়ী মো: শাহজাহান আনসারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিদিনের সংবাদের কাছে এইসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি সাধারণ মানুষ। আমার সঙ্গে খেলাধুলা কেন্দ্রীক কিছু বিষয়ে অনেকের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি হয়েছে। তারা আমার নামে এইসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।
শাহজাহান আনাসারীকে তার এত বিত্ত বৈভবের উৎস জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমার যদি এত টাকা থাকতো তাহলে ব্যাংকে আমার নামে এত লোন থাকতো না। ব্যাংক এশিয়াতে আমার কোটি টাকার উপর লোন আছে।
জানা গেছে, কথিত এই ইয়াবা ব্যবসায়ী কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের একটি পদে নির্বাচনও করেছিলেন। এই খবরটিও তিনি অস্বীকার করে গেছেন। তিনি বলেন, না না, আমি রাজনীতি করি না। আমি নির্বাচন করেছি এই কথাও সত্য নয়। আমি কয়েকটি খেলাধুলা সংঘটনের সঙ্গে জড়িত।
এই বিষয়ে কক্সবাজার সদর থানার ওসি রনজিত কুমার বড়ুয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এই শাহজাহান আনসারী নামে কথিত ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে এইসব অভিযোগ আমরাও শুনেছি। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো প্রমান নেই। একজন ইয়াবা ব্যবসায়ীকে ইয়াবাসহ হাতেনাতে পাওয়া না গেলে তাকে তো আমরা গ্রেপ্তার করতে পারি না। মাদক ব্যবসা ভয়ংকর অপরাধ। আমরা এইসব অপরাধীদের প্রমানসহ ধরতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে আইনানুগ ব্যবস্থা নিই।
ওসি বলেন, যেমন ধরুন একজনের নামে অস্ত্রব্যবসার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাকে যদি অস্ত্রসহ ধরতে না পারি তাহলে তাকে কিভাবে গ্রেপ্তার দেখাবো। এখানে সিআইড আছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আছে, সবাই সচেষ্ট হয়ে এইসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে তারা অচিরেই গ্রেপ্তার হবে।
এইসব বিষয়ে জানার জন্য কক্সবাজার মাদ্রকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অফিস ও কর্মকর্তাদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রশাসনের সহযোগিতা না পেলে এইসব ইয়াবা ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা চালাতে পারে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক একজন স্থানীয় বলেন, এই শাহজাহান কক্সবাজারে ভয়ংকর মাদকের নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণীও টাকার লোভে তার ফাঁদে পা দিয়ে ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়ছে। তাকে গ্রেপ্তার করা না হলে সর্বনাশা ইয়াবার হাত থেকে কক্সবাজারকে বাঁচানো যাবে না।