জুবায়ের চৌধুরী

  ১১ ডিসেম্বর, ২০১৭

আদালতের নির্দেশনা মানছে না পুলিশ!

*আসামি ও সন্দেহভাজনকে ধরা হচ্ছে সাদা পোশাকে *গুম-নিখোঁজে ‘ইঙ্গিত’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে *৯ মাসে সাদা পোশাকে তুলে নেয়া হয়েছে ৫০ জনকে

উচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষা করেই অভিযুক্ত আসামি কিংবা সন্দেহভাজন যে কাউকে ধরতে এখনো সাদা পোশাকে ও পরিচয়পত্রহীনভাবেই অভিযানে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ২০১৬ সালের ২৪ মে উচ্চ আদালতের এক রায়ে সাদা পোশাকে কাউকে আটক, পুলিশ হেফাজতে রিমান্ড কিংবা পরিচয় না দিয়ে কাউকে গ্রেফতার করা বেআইনি ঘোষণা করা হয়। কোনো অপরাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে ডেকে নিলে নিকট আত্মীয়দের জানাতে হবে। সাদা পোশাকে ও বিনা পরোয়ানায় পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না। উচ্চ আদালতই পুলিশকে এসব নির্দেশনা দিয়েছেন। তবু এসব মানছে না পুলিশ।

উচ্চ আদালতের ওই রায়ের পর ধারণা করা হয়েছিল, সাদা পোশাকে কিংবা বিনা পরোয়ানায় (৫৪ ধারা) আটকের বিষয়ে পুলিশের স্বেচ্ছাচারিতা কমে আসবে। পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থাও ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটেনি। উল্টো কাউকে আটক করলে পুলিশ তার বিরুদ্ধে অস্ত্র-মাদকসহ বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে দিচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। পুলিশ এখনো সাদা পোশাকেই মামলার আসামি কিংবা সন্দেহভাজন কাউকে ধরতে যাচ্ছে। আবার কখনো কখনো অভিযুক্ত ব্যক্তি কিংবা তাদের স্বজনরা পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে তা মানছে না পুলিশ! এতে দুই পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে। কখনো তা সংঘর্ষের রূপ নিচ্ছে।

৫৪ ধারায় গ্রেফতার বিষয়ে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, এমনিতেই ৫৪ ধারায় খুব কমসংখ্যক লোককে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ সব সময় আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ীই কাজ করে থাকে। অযথা হয়রানির জন্য কাউকে গ্রেফতার করে না পুলিশ। তিনি আরো বলেন, ১৬৭ ধারায়ও পুলিশ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ীই কাজ করে এবং আগামীতেও আদালত যেভাবে বলেছেন সেভাবেই পুলিশ কাজ করবে।

সাম্প্রতিক গুম, নিখোঁজ ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সুসংহত থাকলেও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে তা ব্যাহত হচ্ছে। দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী মানবাধিকার সুরক্ষা এখনো প্রত্যাশার কাছাকাছি নেই। বিশিষ্টজনের অভিমত, গুম ও নিখোঁজের ঘটনার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। তবে সরকারের দাবি, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির আগের তুলনায় উন্নতি হয়েছে। বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা অনেক কমেছে।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন মনে করেন, এ ধরনের নানা আইন ব্যবহার করে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের সুযোগ নেওয়া ঠিক নয়। তিনি বলেন, ৫৪ ধারায় গ্রেফতার নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে অন্য আইনের ব্যবহার করা, স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন। আদালত সংশোধনী দেওয়ার যে কথা বলেছেন সেটা বলবেন, কিন্তু বিনা পরোয়ানায় আটক করা যাবে না সেটা তো সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া গণগ্রেফতার সভ্যসমাজে হতে পারে না।

গত শনিবার রাজধানীর মৌচাকের ফরচুন শপিং মলে আইসিটি আইনের মামলায় এক ব্যবসায়ীকে ধরতে সাদা পোশাকে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। ব্যবসায়ী জানান, গত শনিবার রাত ৯টায় ছয়-সাতজন লোক ফরচুন শপিং মলে আসেন। তারা ‘ঐশ্বরিয়া শাড়ি বিতান’-এর মালিক মাজরুল ইসলাম ইরানকে আটক করেন। এ সময় উপস্থিত ব্যবসায়ীরা তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদের ডিবি পুলিশের সদস্য বলে পরিচয় দেন। তবে ব্যবসায়ী ইরানকে আটকের কারণ কিংবা গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখাননি। এমনকি তাদের পরনে ডিবি পুলিশের পোশাক, ওয়াকিটকি বা অস্ত্র কিছুই ছিল না। তাদের এ অবস্থায় দেখে সাধারণ মানুষের সন্দেহ হয়। পরে তারা সবাইকে আটকে রাখেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে রমনা থানার ওসি ঘটনাস্থলে পৌঁছে ডিবি পুলিশ সদস্যদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এর আগে ব্যবসায়ীদের হামলার শিকার হন ডিবি পুলিশ সদস্যরা।

সর্বশেষ গত ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে নিখোঁজ হন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। কয়েক মাস আগেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ধানমন্ডি থেকে এক চিকিৎসককে তুলে নেওয়া হয়। সেই চিকিৎসক এখনো নিখোঁজ। এরপর নিখোঁজ হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুবাশ্বার হাসান। গত ২৭ আগস্ট ধানমন্ডি থেকে নিখোঁজ হন কানাডার মন্ট্রিয়লের ম্যাগসাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ। গত ২৬ আগস্ট পল্টন থেকে নিখোঁজ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমানকে এখনো পাওয়া যায়নি। এ ছাড়াও গত তিন মাসে সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও ছাত্রসহ আরো অনেকেই নিখোঁজ হয়েছেন। প্রায় সবাইকেই তুলে নেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে। কিন্তু পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দাবি করা হচ্ছে, এসব নিখোঁজ-গুমের পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কোনো হাত নেই। দুর্বৃত্তরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম করছে।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে করা প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, নয় মাসে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘হেফাজত’ ও ‘ক্রসফায়ারে’ ১২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে ৫০ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে পরে তাদের মধ্য থেকে সাতজন ফিরে আসেন স্বজনদের কাছে। নিখোঁজ থেকে দীর্ঘদিন পর যারা ফিরে এসেছেন তারা আবার মুখ খুলছেন না। একেবারেই নিশ্চুপ। তবে সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া থেকে ফিরে আসা বিশিষ্ট কবি ফরহাদ মজহার মুখ খুলেছেন। তিনি দাবি করছেন, তাকে গুম করতেই তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশি তৎপরতায় তা সম্ভব হয়নি। আবার এই পুলিশের বিরুদ্ধেই তার অভিযোগ, তার কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করে নিয়েছে পুলিশ। তবে কে বা কারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে তিনি কথা বলেননি।

মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছর ১০ মাসে সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান ও সাংবাদিক উৎপলের মতো নিখোঁজ হয়েছেন ৫৪৪ জন। তাদের মধ্যে ৩৯৫ জনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। চলতি বছরের ১০ মাসেই নিখোঁজ হয়েছে ৫০ জন, যাদের ৩৮ জনের খোঁজ মেলেনি। লাশ পাওয়া গেছে দুজনের। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনায় আবার নিখোঁজ বা গুম উৎকণ্ঠা বেড়েছে। অন্যদিকে গত ১০ মাসে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন ১৩৯ জন। চার বছরে এভাবে নিহত হয়েছেন ৬৫৪ জন।

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল রোববার দেশে পালিত হলো ৬৯তম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। দেশের মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, একের পর এক মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের লাশ উদ্ধারের ঘটনাই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় খারাপ দিক। ঘটছে বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এসব ঘটনার সুরাহা না হওয়া চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকায় মানবাধিকার ও অপরাধের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার পাশাপাশি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রতিটি ঘটনা তদন্তের সুপারিশ করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্য মতে, চলতি বছর ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কমিশনের কাছে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন ঘটনায় ৪৩৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৪৪টি। গত বছর অভিযোগ ছিল ৬৬৫টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৯২টি। গত পাঁচ বছরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ১৮৫টি ঘটনার ক্ষেত্রে প্রতিবেদন চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু মন্ত্রণালয় এই সময়ে একটি চিঠিরও কোনো জবাব দেয়নি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘আমাদের কাছে বেশির ভাগ অভিযোগ আসে পুলিশের বিরুদ্ধে। আমরা যখন এসব অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাই, তখন তাদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাই না, যা আমাদের হতাশ করেছে।’

দীর্ঘদিনেও খোঁজ মেলেনি যাদের : ২০০৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী মোজাফফর আহমদ (৬৫)। আগের দিন ৮ সেপ্টেম্বর বাসায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন ডা. নুশরাত। ২০১০ সালের ২৪ মার্চ মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে নিখোঁজ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী সুজনকে এখনো পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালের ১৭ এপ্রিল কুড়িল বিশ্বরোড থেকে নিখোঁজ হন ঝালকাঠির রাজাপুর থানা যুবদল নেতা মিজানুর রহমান জমাদ্দার ও তার দুই সঙ্গী মুরাদ ও ফোরকান। একই বছরের ২৫ জুন রাতে ঢাকা মহানগর ৪১ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৮ নভেম্বর গাজীপুর থেকে নিখোঁজ হন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর আহলা করলডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম বাছা। ২৩ নভেম্বর রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে নিখোঁজ হন বরিশাল উজিরপুরের হাতরার সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন খান।

২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বনানীর নিজ বাসার সামনে থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও তাদের কোনো খোঁজ মেলেনি। এরপর ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এক মাসে রাজধানী থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন ১৯ জন। তাদের কেউই পরে আর ফেরেননি। গত পাঁচ বছর বিভিন্ন কর্মসূচিতে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন তাদের স্বজনরা। গতকাল রোববারও তাদের স্বজনরা জাতীয় প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন করেছেন। এখনো প্রিয়জনের পথ চেয়ে বসে আছেন তারা। একইভাবে ২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর এলাকা থেকে নিখোঁজ হন মফিজউদ্দিন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মানবাধিকার,নিখোঁজ,গুম,অপরাধ,পুলিশ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist