গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৭ নভেম্বর, ২০১৭

বিআরটিসি নিয়ন্ত্রণের চাবি ডিপো ম্যানেজারের হাতে!

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) নিয়ন্ত্রণের চাবি ডিপো ম্যানেজারের হাতে। এ কারণে সংস্থাটির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক চেয়ারম্যানকে নেপথ্যে ‘ঢাল তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার’ ডাকা হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার একক কর্তৃত্ব নেই। এ ছাড়া অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমন পরিস্থিতিতে খাদের কিনারে এসে ঠেকেছে রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন এই প্রতিষ্ঠানটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিআরটিসিকে যুগোপযোগী ও ডিজিটালাইজেশন করার পদক্ষেপে গাফিলতির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি বিআরটিসির প্রশাসনিক দক্ষতা, পরিচালনা সক্ষমতা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। কমিটি নানা বিচার-বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণের পর সংস্থাটিকে ঘুরে দাঁড়াতে ৮ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, ৯ কৌশল অবলম্বন করা এবং ২১ সুপারিশ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে। পাশাপাশি তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিবেদনে ২৪টি সুপারিশ রয়েছে।

এদিকে, বিআরটিসির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং গোয়েন্দা মহা-পরিদফতরের (ডিজিএফআই) দুর্নীতিসংক্রান্ত দুটি প্রতিবেদনের তথ্য যাচাইয়ের লক্ষ্যে গঠিত ওই কমিটিও কাজ করেছে। দুর্নীতির ব্যাপারে সংস্থার চেয়ারম্যানসহ ১৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কমিটিতে তলব করে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সবাই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।

বিআরটিসির নারায়ণগঞ্জ বাস ডিপো ম্যানেজার মো. মাসুদ তালুকদার কমিটিতে তার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন, বিআরটিসিতে কোনো সিন্ডিকেট নেই। তার চাকরির ১২ বছরে তিনি কোনো চাঁদা কাউকে দেননি এবং তার জানামতে কোনো ট্রিপ চুরি হয়নি। তবে, ক্যাশ ইন হ্যান্ড হয়েছে প্রশাসনিক জটিলতার কারণে।

কুমিল্লা ডিপোর পরিযান কর্মকর্তা জামিল হোসেন বলেন, বিআরটিসি এ প্রতিষ্ঠানে টাকা আত্মসাতের কোনো সুযোগ নেই। মতিঝিল বাস ডিপো ও কল্যাণপুর, ঢাকার ম্যানেজার অপারেশন আশরাফুল আলম বলেন, এ প্রতিষ্ঠানে ট্রিপ চুরির কোনো সুযোগ নেই।

বিআরটিসির সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, এ সংস্থায় কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক ব্যক্তি চেয়ারম্যান হয়ে বিআরটিসি চালিয়েছে। সে সময় কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছামতো বিআরটিসি পরিচালিত হতো। তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক বলে দাবি করেন তিনি।

প্রতিবেদনের বলা হয়, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে বিআরটিসি নানা সমস্যায় জর্জরিত। অব্যবস্থাপনার ফিরিস্তিও কম নয়; যার মধ্যে রাজনৈতিক কর্মীদের হস্তক্ষেপ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি, ট্রিপ চুরি, আয়কৃত টানা জমা না করা, অকেজো গাড়ি মেরামতের নামে জালিয়াতি, রানিং মেরামতের নামে লুটপাট, ভারী মেরামত, চালক-শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ না করা, ক্যাশ ইন হ্যান্ড, বিভিন্ন ধরনের ক্রয়ে দুর্নীতি এবং তেল ও লুব্রিকেন্ট-সংক্রান্ত দুর্নীতি। এ ছাড়া ডিপো ম্যানেজাররা এত প্রভাবশালী ছিলেন, তাদের অন্যত্র বদলি করা হলেও তার পছন্দের লোকদের সঙ্গে নিয়ে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতেন।

এ ছাড়া বিআরটিসির আর্থিক সমস্যা কম নয়। ডিপো ম্যানেজাররা কৃত্রিমভাবে এ সংকট তৈরি করে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ সংস্থার বিভিন্ন ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে গত জুলাই পর্যন্ত ২৫ কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার ৭৫৩ টাকা আটকে রয়েছে। যার মধ্যে ১৯ ডিপোর কাছে বকেয়া ১২ কোটি ৪৬ লাখ ৮৯ হাজার ৭৫৩ টাকা। আর ১৬ ডিপোর কাছে বিআরটিসির পাওনা ১৩ কোটি ২৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।

প্রতিবেদনে আট চ্যালেঞ্জের মধ্যে অধিক সংখ্যক রুটে পরিকল্পিতভাবে বাস প্রবর্তন, পরিবেশ দূষণকারী বাসসমূহ রাস্তা থেকে অপসারণ এবং যাত্রী ও সেবাগ্রহণকারীদের মধ্যে বিআরটিসির সুনাম ও আস্থার সৃষ্টি করা। আর ৯ কৌশলের মধ্যে ডিপোতে পড়ে থাকা অকেজো গাড়িগুলোকে বিক্রয় কিংবা দীর্ঘমেয়াদি লিজ দেওয়া, প্রেষণে জনপ্রশাসন থেকে দক্ষ লোকবল নিয়োগ করা, ঢাকা সিটিতে চলাচলরত সব বাসে ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং সিস্টেম, ওয়াই-ফাই সার্ভিস এবং ই-টিকিটিং সিস্টেম চালু করা এবং যাত্রী এবং রুটসমূহের বাস্তব অবস্থা জরিপ করে সেবা প্রদান।

সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, দীর্ঘদিন পর বিআরটিসিকে সক্ষম ও শক্তিশালী করতে মন্ত্রণালয়ের কমিটি যে সুপারিশ করেছে সেগুলো বাস্তবায়ন হলে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। অন্যথায় সরকারি এই সংস্থাটি যে লেজে-গোবরে অবস্থায় চলে আসছে তার কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সড়ক পরিবহন করপোরেশন,বিআরটিসি,অনিয়ম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist