জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট
জীবিত স্বামীকে মৃত দেখিয়ে বিধবা ভাতা : মৃত ব্যক্তির নামে বয়স্ক ভাতা
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিশেষ বরাদ্দে মৃত ব্যক্তির নাম বয়স্ক ভাতার তালিকায় এবং টাকার বিনিময়ে জীবিত স্বামীকে মৃত দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে বিধবা ভাতা। টাকা ছাড়া মিলছে না বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধি ভাতা।
আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা অফিস সুত্রে জানা গেছে, উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের হতদরিদ্র, অতিদরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠিকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ২০১৬/১৭ অর্থ বছরের বিশেষ বরাদ্দের আওতায় আনতে ৬ হাজার ৫২৬ জনকে মনোনীত করা হয়। যার মধ্যে বয়স্ক ২ হাজার ২৬১ জন, বিধবা ২ হাজার ৭৩ জন ও প্রতিবন্ধি ভাতার জন্য ২ হাজার ১৯২ জনকে নির্বাচন করা হয়। বয়স্ক ও বিধবারা প্রতি মাসে ৫ শত টাকা হারে ও প্রতিবন্ধিরা প্রতি মাসে ৬ শত টাকা হারে তিন মাস পর এ টাকা বিতরণ করা হবে।
ভাতাভোগী ও স্থানীয়রা জানান, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভাতাভোগীর তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার পর্যন্ত টাকা গুনতে হয়েছে ভাতাভোগীদের। টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক অতিদরিদ্র বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও বিধবা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। আবার টাকা বিনিময়ে জীবিত স্বামীকে মৃত দেখিয়ে বিধবা ভাতা ও মৃত ব্যক্তিকেও ভাতার জন্য মনোনীত হয়েছেন।
সব থেকে বেশি অনিয়ম মহিষখোচা, সাপ্টিবাড়ি ও কমলাবাড়ি ইউনিয়নে। মহিষখোচা ইউনিয়ন সমাজকর্মী আব্দুল ওহাব টাকা বিনিময়ে ও আত্মীয় স্বজনের মাঝে এসব ভাতাভোগীর তালিকা প্রণায়ন করেছেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। ভাতাভোগীদের বই নিজ বাড়িতে টাকার বিনিময়ে বিতরণ করেন তিনি। সেক্ষেত্রে বই প্রতি ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সাপ্টিবাড়ি ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া প্রত্যেক বিধবা ভাতাভোগীর নিকট থেকে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নাম ভাঙ্গিয়ে পরিষদের চৌকিদারকে দিয়ে এই টাকা আদায় করেন।
টাকার বিনিময়ে জীবিত স্বামীকে মৃত দেখিয়ে তার প্রতিবেশী চাচি রাবেয়া বেগমকে বিধবা ভাতার জন্য মনোনীত করেছেন। শুধু রাবেয়া নন, ওই ইউনিয়নের বিধবা ভাতা তালিকার ১নং ওয়ার্ডের তারামিনা বেগম, ৫নং ওয়ার্ডের ওশনা বেগম, জাহানুর বেগম, ছকিনা বেগমকে বিধবা হিসেবে বলা হলেও তারা স্বামীসহ বসবাস করে আসছেন। ৯নং ওয়ার্ডের হাছমা বেগম ও ৪নং ওয়ার্ডের বাচ্চা বুড়ি'র নামে বিধবা ভাতা এবং তাদের স্বামীর নামে রয়েছে বয়স্ক ভাতা। এতেই শেষ নয় বেশ কিছু মৃত ব্যক্তির নাম রয়েছে বয়স্ক ভাতার তালিকায়। এসব সুবিধা ভোগির তালিকা সমাজকর্মী আব্দুল ওহাব নিজেই তৈরী, যাচাই বাচাই ও বই বিতরণ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহিষখোচা ইউনিয়নের বেশ কিছু ভাতাভোগী জানান, টাকা ছাড়া ওহাবের সাথে কথা বলাও যায় না। বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীকে চাহিদামত টাকা দিয়ে নিতে হয়েছে বই। টাকার বিষয় কাউকে বললে নাম কেটে দেয়ার হুমকী দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন ভুক্তভোগীরা।
আত্মীয়তা ও টাকা গ্রহণের বিষয়টি অস্বীকার করে মহিষখোচা ইউনিয়ন সমাজকর্মী আব্দুল ওহাব জানান, অফিসারের সাথে কথা বলে বাড়িতে কিছু বই বিতরণ করা হয়েছে। যাদের স্বামী জীবিত রয়েছে তাদের নাম বাদ হবে।
মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুল হামিজ বলেন, জনপ্রতিনিধিদের সাথে সমন্বয় না করে ওহাব নিজেই এসব তালিকা করেছেন। তিনি তালিকা যাচাই বাচাই করে প্রকৃত বঞ্চিতদের অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান।
একই অবস্থা কমলাবাড়ি ইউনিয়নের ভাতাভোগীদের। তাদের কাছে প্রকাশ্যে নেয়া হচ্ছে বই প্রতি ৫শত টাকা। যার সিংহভাগ পাচ্ছেন ওই ইউনিয়ন সমাজকর্মীর দায়িত্বে থাকা কারিগরি প্রশিক্ষক ধীরেন্দ্র নাথ রায়। তবে তিনিও অস্বীকার করে বলেন, টাকা নেয়ার প্রশ্নেই উঠে না। বইগুলো ইউপি মাঠেই বিতরণ করা হয়েছে।
আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা অফিসার শরিফুল ইসলাম জানান, বাড়িতে বই বিতরণের কোন নিয়ম নেই। ওই ইউনিয়নের বিষয়ে অনেকে অভিযোগ দিয়েছেন। তিনি প্রশিক্ষণে ঢাকায় অবস্থান করছেন। ফিরে এসে তদন্ত স্বাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসাদুজ্জামান বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমের কোন অনিয়ম দুর্নীতি মেনে নেয়া হবে না। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পিডিএসও/রানা