জুবায়ের চৌধুরী

  ১৪ মার্চ, ২০২০

ডিজিটাল প্রতারণার ভয়ংকর ফাঁদ

তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে প্রতারণার ধরন যেমন বদলেছে, বেড়েছে মাত্রাও। দেশে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে ভয়ংকর সব প্রতারণা হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতারক ও প্রতারণার অভিনব সব কৌশল। বদলে যাচ্ছে প্রতারণার ধরনেও। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ও মোবাইল ফোনে ওত পেতে থাকা প্রতারকরা নানা কৌশলে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা।

প্রতারকরা কখনো জিনের বাদশা সেজে, কখনো ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে প্রতারণা করছে। আবার কখনো রাইড শেয়ারিংসহ নানা কৌশলে প্রতারণা করা হচ্ছে। অনেকে সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করছেন না। ফলে অনেক ঘটনা থেকে যাচ্ছে অজানা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অবস্থাটা এমন— যেন প্রতি এক গজ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে একেকজন প্রতারক। তারা বলছেন, এদের খপ্পর থেকে দূরে থাকার একমাত্র মাধ্যম সচেতনতা। পাশাপাশি লোভের ফাঁদে পা না দেওয়ারও পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সংস্থা জানিয়েছে, নানা কায়দায় প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়। সহজ-সরল মানুষই প্রতারকদের প্রধান তার্গেট। সুযোগ বুঝেই নানা ছলচাতুরি ও মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে। এসব প্রতারণার মধ্যে কম খরচে বিদেশ পাঠানোর প্রলোভন, বিকাশ বা মুঠোফোনে বড় পুরস্কার জেতা, জাদুর বাক্সে টাকাকে ডলারে রূপান্তর, কম দামে ভালো জিনিস বিক্রির নামে পুরোনো কাপড় গছিয়ে দেওয়া, অনলাইনে বিনিয়োগ করে দ্রুত অধিক মুনাফা অর্জন ও ভাগ্য পরিবর্তন ইত্যাদি বিচিত্র এবং অভিনব কৌশলে প্রতারণা করে চক্রের সদস্যা। ভয়ংকর সব প্রতারণার অভিযোগ থাকলেও নেই প্রতিকার। মামলার পর গ্রেফতার হলেও দ্রুত জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠছে চক্রের সদস্যরা। শুধু রাজধানীতে কয়েক হাজার প্রতারক সক্রিয়। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও প্রতারক চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হচ্ছে। এর মধ্যে ডিজিটাল প্রতারকই বেশি।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কিছু অসৎ ব্যক্তি তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করছে। যার ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে। অথচ একটু সচেতনতা এবং বাস্তব বুদ্ধি প্রয়োগ করে প্রযুক্তিনির্ভর এই প্রতারণা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। পুলিশের আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, যে হারে সাইবার অপরাধ বেড়েছে তার জন্য সাইবার ক্রাইমের জন্য রাজধানীতে বিশেষ থানা হওয়া প্রয়োজন। ঢাকায় একমাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আদালত অবস্থিত। এ আদালত দেশের বিভাগীয় শহরে সম্প্রসারিত হলে সাইবার অ্যাক্টে করা মামলার বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন হবে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম জানান, ডিজিটাল মাধ্যমে সবকিছু মুছে দেওয়া যায় না। সব থেকে যায়। এটা লোকজনকে জানাতে হবে। শুধু আইন প্রয়োগ বা অপরাধীদের গ্রেফতার করে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সূত্রাপুর থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী জানান, প্রচলিত অপরাধ ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দস্যুতা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় কমেছে, কিন্তু বেড়েছে সাইবার অপরাধ। তবে পুলিশের সাইবার ইউনিট তৈরি হওয়ার পর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে।

জিনের বাদশা : জাহানারা বেগম (ছদ্মনাম) অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তিনি একটি বিজ্ঞাপন দেখেন, যেকোনো সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে জীনের বাদশা। বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে জাহানারা বেগমকে জানানো হয়, ২০০১ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তিনি সেটা করার পর একজন তাকে ফোন করে বলেন দরবেশ হুজুর তার সঙ্গে কথা বলবেন এবং জিনের বাদশাকে ব্যবহার করে তার মনোবাসনা পূরণ করবেন। এভাবেই শুরু। কয়েক মাসে জীনের বাদশা জাহানারার সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা চালাতে থাকে। একপর্যায়ে তাকে বলা হয় জিনের বাদশা তার প্রতি সদয় হয়েছেন এবং তার সঞ্চয়ের টাকা দ্বিগুণ করে দিতে রাজি হয়েছেন।

পরে বিকাশের মাধ্যমে কয়েক কিস্তিতে জাহানারা বেগম ২৫ লাখ টাকা তুলে দেন কথিত ওই জিনের বাদশার হাতে। এই টাকা ছিল জাহানারার সারা জীবনের সঞ্চয়। তার কাছে রাখা কিছু সঞ্চয়পত্রও তিনি ভাঙিয়ে নেন। শুধু তাই না, জীনের বাদশাকে দেওয়ার জন্য তিনি তার এক প্রতিবেশীর কাছে ঋণের জন্য হাত পাতেন। ওই প্রতিবেশী যখন জাহানারার ছেলেকে ঘটনাটা জানিয়ে দেন তখন পুরো ব্যাপারটা বেরিয়ে আসে। ছেলে এ নিয়ে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেন যে, প্রতারকদের একটি চক্র তার মাকে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

ভুয়া ফেসবুক আইডি : সম্প্রতি ভুয়া ফেসবুক আইডি দিয়ে প্রতারণার অভিযোগে একজনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। তিনি ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে নারীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের পর তাদের প্রলুব্ধ করে পুরুষ ক্লায়েন্টদের চাহিদামতো সরবরাহ করত। বিষয়টি সিআইডি মনিটরিং সেল দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করছিল। নিজস্ব প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মনিটরিং সেল তাকে চিহ্নিত করে আটক করে।

মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা : এজেন্ট ও গ্রাহকের সমন্বয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে এ চক্র। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে সহজেই অপরাধীরা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কয়েক মাস আগে একটি চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্তে জানা যায়, মিতু আক্তারের (ছদ্মনাম) মোবাইল ফোনে একদিন বলা হয়, আপনার সন্তান অপহৃত হয়েছে। যদি সন্তান ফেরত চান ইমোতে নগ্ন হয়ে ভিডিও কল দিতে হবে। সন্তানের কথা ভেবে তিনি তা করেন। যদিও কিছু সময় পর তিনি জানতে পারেন অপহরণের বিষয়টা মিথ্যা। পরবর্তী সময়ে চক্রটি ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করত। অনলাইনে যৌন নিপীড়ন : সিআইডি সম্প্রতি একজনকে গ্রেফতার করে। তিনি নিজেকে প্রবাসী পরিচয় দিয়ে নারীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করত। পরে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে খোলামেলা ছবি সংগ্রহ করত। এরপর বিভিন্ন অজুহাতে টাকা দাবি করত। যারা রাজি হতো না, তাদের নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি তৈরি করে ভিকটিমদের নগ্ন ছবি প্রকাশ করে।

রাইড শেয়ারিং প্রতারক চক্র : প্রতারকরা চালকদের কাছ থেকে মিথ্যা কথা বলে গাড়ির কাগজ, আইডি কার্ডের কপিসহ অন্যান্য কাগজপত্র সংগ্রহ করে। নকল অ্যাপস বানিয়ে সেখানে চালকদের রেজিস্ট্রেশন করায়। এরপর আর্থিক লেনদেনের জন্য ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ভয়ংকর অপরাধ,ফাঁদ,প্রতারণা,ডিজিটাল প্রতারক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close