নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০২ মার্চ, ২০২০

মডেল দিয়ে ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল করতেন পাপিয়া

প্রায় ২ মাস আগে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর কক্ষে এক মডেল পাঠান নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। এরপর ওই মডেল ও ব্যবসায়ীর অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ভিডিও করেন পাপিয়াসহ তার সঙ্গীরা। ইজ্জত বাঁচাতে পাপিয়াকে ২০ লাখ টাকা দেন ওই ব্যবসায়ী। র‌্যাবের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ওই ব্যবসায়ী ২০ লাখ টাকার শোধ নিতে পাপিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে ওই ব্যবসায়ী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) কাছে এ ঘটনায় পাপিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। অভিযোগের পর ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য নেন র‌্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এরপর গোয়েন্দারা পাপিয়াসহ তার সহকর্মীদের দিকে নজরদারি বাড়ান। র‌্যাবের সূত্রটি জানায়, অভিযোগ পেয়ে রাজধানীর গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে খোঁজখবর নিতে শুরু করে র‌্যাব। তবে এই খবর পাপিয়ার কাছে পৌঁছে যায়। পরে পাপিয়া ও তার সঙ্গীরা বিদেশ পালানোর চেষ্টা করেন।

সর্বশেষ গত ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন। এই খবর জানতে পারে র‌্যাব। পরে শামীমা নূর পাপিয়া, তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী, সহযোগী সাব্বির খন্দকার ও শেখ তায়্যিবাকে গ্রেফতার করে র‌্যাবের একটি দল।

পাপিয়ার মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, র‌্যাবের গোয়েন্দারা পাপিয়াকে নজরদারিতে রাখার পর জানতে পারেন, পাপিয়া শুধু ওই ব্যবসায়ী নন, এমন অনেক অভিজাত লোককে সুন্দরী তরুণী পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

এদিকে জাল টাকা সরবরাহ, মাদক ব্যবসা ও অনৈতিক কাজের অভিযোগে গ্রেফতার পাপিয়ার দুই সহযোগীর ফের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রিমান্ড মঞ্জুর হওয়া আসামিরা হলেন সাব্বির খন্দকার (২৯) ও শেখ তায়্যিবা (২২)। গতকাল রোববার ৫ দিনের রিমান্ড শেষে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিদার হোসাইন ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এদিন শামীমা নূর পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমনকে এ মামলায় তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে বিচারক তাদের দুজনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীদের ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পাপিয়া দেশ-বিদেশের উঠতি মডেলদের ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসতেন মডেলদের। মোটা অঙ্কের লেনদেন হতো মডেলদের সঙ্গে। মডেলদের বাংলাদেশে এনে কিছু দিন রেখে আবার পাঠিয়ে দেওয়া হতো। মডেলদের বিমান ভাড়া দিতে হতো মোটা অঙ্কের টাকা।

শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে এক মাস আগে রাশিয়ার কয়েকজন মডেলও নিয়ে এসেছিলেন পাপিয়া। এরপর ইমিগ্রেশন থেকে ওই মডেলদের আটকে দেওয়া হয়। কারণ তারা বাংলাদেশে আসার নির্দিষ্ট কারণ বলতে পারেননি। এরপর শামীমা নূর পাপিয়া বিভিন্ন ক্ষমতাশালীকে দিয়ে ওই মডেলদের বের করে নিতে সক্ষম হন।

এ বিষয়ে র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, পাপিয়ার বিদেশ থেকে মডেল আনার খবর আমরাও শুনেছি। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আমরা কিছুই জানি না। আমরা এই মামলার তদন্তভার চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। তদন্তের দায়িত্ব পেলে আমরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।

সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, আমাদের কাছে পাপিয়ার বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলসহ নানা ধরনের অভিযোগ ছিল। আমাদের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তার ব্যাপারে বিস্তারিত জেনেছি। এরপর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে কয়েক মাস ধরে বুক করে অবৈধ নারী, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছিলেন শামীমা নূর পাপিয়া। র‌্যাব বলছে, গত তিন মাসে শুধু ওই হোটেলেই পাপিয়া বিল দিয়েছেন ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। হোটেলটির বারে তিনি প্রতিদিন বিল দিতেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এই হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট বরাদ্দ ছিল পাপিয়ার।

ওয়েস্টিন হোটেলের ২২ তলায় সবচেয়ে বিলাসবহুল প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটটিতে থাকতে বহু টাকা গুনতে হতো পাপিয়াকে। চার বেডরুমের ওই স্যুটের প্রতি রাতের ভাড়া সাধারণভাবে ২ হাজার ডলারের মতো।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাপিয়া তার অতিথিদের প্রথমে নিয়ে যেতেন ওয়েস্টিনের লবিতে। পরে লাঞ্চ বা ডিনার শেষে সেখান থেকে নিয়ে যেতেন তার নামে বরাদ্দকৃত বিলাসবহুল প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে। ২৩ তলাবিশিষ্ট ঢাকা ওয়েস্টিন হোটেলের লেভেল-২২ এ ১ হাজার ৪১১ বর্গফুট জায়গাজুড়ে বিলাসবহুল প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট। সেখানে অতিথিদের সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ বৈঠক করতেন পাপিয়া। এরপর পছন্দসই তরুণীকে নিয়ে গোপন কক্ষে প্রবেশ করতেন ভিআইপিরা।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে প্রথম অনলাইনভিত্তিক যৌন ব্যবসার প্ল্যাটফর্ম ‘এসকর্ট’ গড়ে তোলেন যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। এটি গড়ে তুলতে রাজনীতিকে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। এখান থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুন্দরী তরুণী সরবরাহ করা হতো। কয়েক বছর আগে ‘এসকর্ট’টি গড়ে তোলা হলেও এরই মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সারা দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয়। যৌন ব্যবসার অনলাইনভিত্তিক সাইট ‘এসকর্ট’ এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় রয়েছে। রিমান্ডের প্রথম দিনেই জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছেন সদ্য বহিষ্কৃত যুব মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়া। এসকর্টের সঙ্গে জড়িত দেহ ব্যবসায়ী সুন্দরী তরুণী এবং তাদের খদ্দেরদের নামও বলেছে পাপিয়া।

র‌্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর ফার্মগেটের ২৮নং ইন্দিরা রোডের ‘রওশনস ডমিনো রিলিভো’ ভবনে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে পাপিয়া-মতি সুমনের। এছাড়া নরসিংদী শহরে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নরসিংদীর বাগদী এলাকায় কোটি টাকার দুটি প্লট রয়েছে। তাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য রয়েছে কয়েকটি বিলাসবহুল গাড়ি।

এছাড়া তেজগাঁও বিএফডিসি গেটের পাশে অংশীদারিত্বে পাপিয়ার ‘কার একচেঞ্জ’ নামে একটি গাড়ির শোরুম রয়েছে। নরসিংদী জেলায় ‘কেএমসি কার ওয়াশ অ্যান্ড অটো সলিউশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া পাপিয়া-মতি সুমন দম্পতির দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত থাকার তথ্যও রয়েছে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পাপিয়া,শামীমা নূর পাপিয়া,ব্ল্যাকমেইল,মডেল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close