জুবায়ের চৌধুরী

  ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

‘আল্লাহর দল’ ব্যানারে সংগঠিত হচ্ছে জঙ্গিরা

বাংলাদেশে সর্বশেষ নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনটি হচ্ছে ‘আল্লাহর দল’। গত বছরের ৬ নভেম্বর এ সংগঠনের সব ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে সরকার। নিষিদ্ধের পর থেকে নতুন সদস্য ও সংগঠনের তহবিল সংগ্রহে নতুন কৌশলে সক্রিয় হয়েছে উগ্রবাদী গোষ্ঠীটি। সংগঠনটির সদস্যরা মনে করে বর্তমানে যুদ্ধাবস্থা চলছে। আর তাই তারা ঈদ, কোরবানি, হজ পালন করা থেকে বিরত থাকে। তারা জুমার নামাজও আদায় করে না। প্রতি ওয়াক্তের শুধু দুই রাকাত নামাজ আদায় করে থাকে ‘আল্লাহর দলের’ সদস্যরা। এসব আদর্শ নিয়েই তারা ‘আল্লাহর সরকার’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

গোয়েন্দা তথ্য মতে, এই সংগঠনের নেতৃত্বে যারা আছেন তারা জেএমবি বা হরকাতুল জিহাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত। মূলত জেএমবি বা হরকাতুল জিহাদের কর্মীরাই ‘আল্লাহর দল’ নামে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন সংগঠনে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য সদস্য। আগামীতে এই জঙ্গি সংগঠনটি সরকারের মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জেএমবি পুনর্গঠনের নতুন কৌশল হচ্ছে ‘আল্লাহর দল’ নাম ধারণ করা। এক হাজারেরও বেশি জঙ্গি ভাগ হয়ে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করা এবং সদস্য সংগ্রহের জন্য মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে গোপনে এবং ছদ্মনামে বিভিন্ন কর্মকা-ের অন্তরালে এসব নেতা দলের কার্যক্রম চালাচ্ছে। ২০১৭ সালে সিলেটে ‘আল্লাহর দলের’ সাত সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরই মধ্যে কেউ ফুটপাতের হকার, কেউ রাস্তার পাশে ছোটখাটো দোকান চালাত। তারা প্রতিদিন ১০০ টাকা বিক্রি করলে ৫টা আল্লাহর দলের সদস্যকে চাঁদা দিত। এ চাঁদা কয়েকটি হাত পরিবর্তন করে মূল জঙ্গিদের কাছে চলে যেত।

গত বছরের আগস্টে রাজধানীর দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ‘আল্লাহর দল বা আল্লাহর সরকারের’ চার সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তখন র‌্যাব জানিয়েছিল, পূর্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে জঙ্গিরা নতুন করে ‘আল্লাহর দল’ নামে সংগঠিত হচ্ছে। তাদের মতো এত ঐক্য অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনে দেখা যায়নি। জানা গেছে, জঙ্গিরা ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। ‘আল্লাহর দল’ পরিচয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে স্বল্পশিক্ষিত লোকজনকে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে দলে টানছে। দলের সদস্য করে তাদের জঙ্গি তৎপরতায় উদ্বুদ্ধ করতে নানা কৌশল প্রয়োগ করছে। তারা বিভিন্ন পেশার লোকজন থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করে সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছে। এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে টাকা নিচ্ছে। অনেকেই সরল বিশ্বাসে এ সংগঠনের জন্য টাকা দিচ্ছে।

‘আল্লাহর দল’ নিষিদ্ধ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত শতাধিক সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। গ্রেফতার হওয়াদের স্বীকারোক্তিতে জঙ্গি তৎপরতার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসছে। তারা স্বীকার করে যে, জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি, ধর্মীয় উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য একত্র হয়ে তারা সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর হামলার পরিকল্পনাও ছিল তাদের।

এন্টি টেররিজম ইউনিটের পুলিশ সুপার মাহিদুজ্জামান জানান, দেশের উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও রংপুর এলাকায় দরিদ্র গ্রামগুলোতে ‘আল্লাহর দলের’ উৎপত্তি। এখন তারা সিলেট বিভাগ ও মেট্রোপলিটন এলাকাকেন্দ্রিক সংগঠিত হচ্ছে। তারা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে অর্থসংগ্রহ করছে। সিলেটে প্রবাসীর সংখ্যা বেশি বলে তারা প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা নেয়। প্রবাসীদের পরিবার থেকে আল্লাহর দলের নামে আমানত (অর্থ) সংগ্রহ করছে। তারা জানায়, তাদের বহু মৌন সমর্থকও সে এলাকায় রয়েছে। টাকা সংগ্রহ করে তারা সংগঠনের প্রশিক্ষণের ব্যয় নির্বাহ করছে।

তিনি আরো জানান, এ সংগঠনের টার্গেট মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের বেকার যুবক। বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে হাতখরচ বাবদ দৈনিক ৫০ থেকে ২০০ টাকা দেওয়া হয়। এভাবে অর্থের লোভ দেখিয়ে বলা হয় কাজ করলে আরো টাকা পাওয়া যাবে। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে নতুন সদস্যদের মধ্যে জিহাদি মনোভাব সৃষ্টি করা হয়। গোপনে তারা নিজেদের খেলাফতি কায়দায় গড়ে তোলে। প্রত্যেক জেলায় ও উপজেলায় দলনেতা নির্বাচনের পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়েও দলনেতা নিযুক্ত করা হয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে গাইবান্ধার উগ্র জঙ্গিবাদী নেতা মতিন মেহেদী ‘আল্লাহর দল’ নামক জঙ্গি সংগঠনটি গড়ে তোলে। পরে সে জেএমবি বা হরকাতুল জিহাদের হয়েও কাজ করে দীর্ঘদিন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক ধরপাকড়ের মুখে আড়ালে থাকতে ব্যানার হিসেবে আগের নাম ‘আল্লাহর দল’ ব্যবহারে শুরু করে। পাশাপাশি জঙ্গি এ সংগঠনটি ‘আল্লাহর সরকার’ নামে পরিচিত। গত বছরের ৬ নভেম্বর ‘আল্লাহর দল’ নিষিদ্ধ হয়।

এর আগে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা ও উগ্র ইসলামি সংগঠন সাতটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে, জেএমবি, জেএমজেবি, হুজি, শাহাদাৎ-ই আল-হিকমা, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং আনসার আল ইসলাম। এর মধ্যে জেএমবিসহ চারটি সংগঠন নিষিদ্ধ হয় ২০০৫ সালে। বোমা হামলা চালিয়ে বিচারক হত্যার দায়ে জেএমবির শীর্ষনেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। আর উগ্রপন্থা প্রচারের জন্য ২০০৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয় হিযবুত তাহরীরকে।

এদিকে পুলিশ ও র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যে নেতৃত্বশূন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) তৎপরতার খবর আসে। সংগঠনটির আমির মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানী ওই মামলার রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাভোগ করছেন। তার দুই অনুসারীর মৃত্যুদণ্ড, একজনের যাবজ্জীবন এবং আরো চারজনের বিভিন্ন মেয়াদের সাজার রায় এসেছে। ২০১৫ সালের মে মাসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর সদস্যরাই সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পরিকল্পনাকারী বরখাস্ত মেজর জিয়াউল হকের নেতৃত্বে আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা চালিয়ে আসছিলেন। ২০১৭ সালের মার্চে আনসার আল ইসলামকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার।

সাম্প্রতিক সময়ে জেএমবির সহযোগিতায় ‘আল্লাহর দল’ সারা দেশে নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে বলে জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত বছরের আগস্টে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ‘আল্লাহর দলের’ ভারপ্রাপ্ত আমির ইব্রাহিম আহমেদ হিরোসহ আট শীর্ষ নেতা র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন। র‌্যাব কর্মকর্তারা তখন জানান, ১৯৯৫ সালে মতিন মেহেদী ওরফে মুমিনুল ইসলাম আল্লাহর দল নামে এ সংগঠন গড়ে তোলেন। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও সাদুল্লাপুর থানা এলাকা থেকে তাদের সদস্য সংগ্রহ শুরু করা হয়। ২০০৪ সালের শেষের দিকে সংগঠনটি জেএমবির সঙ্গে একীভূত হয়। পরের বছর ১৭ আগস্ট সারা দেশে জেএমবির বোমা হামলাতেও আল্লাহর দলের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যায়।

এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযনে জেএমবি দুর্বল হয়ে পড়লে মতিন মেহেদী আবার ‘আল্লাহর দল’ নিয়ে সক্রিয় হন। ঝিনাইদহে ১৭ আগস্টের বোমা হামলার ঘটনায় ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেলার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল যে ২১ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাদের মধ্যে মতিন মেহেদীও একজন। তখন তিনি পলাতক থাকলেও ২০০৭ সালে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েন। মতিন মেহেদী কারাগারে যাওয়ার পর তাকেই আমির হিসেবে মেনে ভারপ্রাপ্ত আমির হন গাড়ির যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ী ইব্রাহিম আহমেদ হিরো। গত ১৮ আগস্ট তিন সহযোগীসহ ঢাকার হাতিরঝিলের ঝিলপাড় এলাকায় গ্রেফতার হন তিনি।

এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর মেহেরপুর জেলায় ‘আল্লাহর দলের’ আট সদস্যকে আটক করে পুলিশ। এর আগে ২০১৮ সালে নভেম্বরে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় এই দলের আরো চার সদস্য পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের বাহুলা থেকে ‘আল্লাহর দলের’ সক্রিয় সদস্য শফিকুল ইসলাম রানাকে গ্রেফতার করে এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। তিনি এ দলটির হবিগঞ্জ জেলা শাখার প্রধান ছিলেন।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এমরানুল হাসান পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, কৌশলগত কারণ ২০১৪ সালে আল্লাহর দলের নাম পরিবর্তন করে ‘আল্লাহর সরকার’ রাখা হয়। দেশের উত্তর, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ কয়েকটি জেলায় সদস্য সংগ্রহ অভিযানে নেমেছিলেন তারা। সদস্য সংগ্রহের জন্য এই জঙ্গিরা ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করার মাধ্যমে সাংগঠনিক কাঠামো মজবুত করার পরিকল্পনা করেছিল।

প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে কারাবন্দি আমির মতিন মেহদীকে মুক্ত করার পরিকল্পনাও তাদের ছিল। হিরোসহ চারজনকে গ্রেফতারের পর তাদের দেওয়া তথ্যে, ২৭ আগস্ট রাতে দক্ষিণখানের আশকোনা থেকে ‘আল্লাহর দলের’ আরো চার নেতাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
‘আল্লাহর দল’,জঙ্গি গোষ্ঠী,জেএমবি,জঙ্গি সংগঠন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close