জুবায়ের চৌধুরী

  ০২ অক্টোবর, ২০১৯

‘থাই ডন’ সেলিমের বিলাসী জীবন

ক্যাসিনো-কাণ্ডের পর একে একে অপরাধ জগতের অলিগলির অজানা দিক বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। উন্মোচিত হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা মাফিয়াদের পরিচয়। সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর গুলশানে একটি অভিজাত স্পা সেন্টারের মালিক সেলিম প্রধানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। সেলিম প্রধান অনলাইনে ক্যাসিনো পরিচালনাকারী এবং বাংলাদেশের কান্ট্রি প্রধান। তিনি ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সহসভাপতি। এছাড়া এর আগে গ্রেফতার হওয়া বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার ক্যাশিয়ারও ছিলেন তিনি। তবে সেলিম প্রধানের আসল পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও অন্ধকার জগতে তাকে অনেকেই চেনেন ‘থাই ডন’ হিসেবে। কারণ তার বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ও পাতায়া শহরে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনাই নয়, সেলিম প্রধান রাজশাহীসহ সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় গবাদিপশুর সব খাটাল ও মাদক সিন্ডিকেটের হোতা। এমনকি সীমান্তে জাল টাকার মূল সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে তিনি খাটাল, মাদক ও জাল টাকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। সেখান থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা নেন। দুই বছরে তিনি সীমান্ত এলাকা থেকে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা নিয়েছেন।

দেশ-বিদেশে রাজকীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন সেলিম প্রধান। তার এমন চলাফেরা দেখে অনেকে হতভম্ব হয়ে যান। গাড়ির বহর আর অস্ত্রধারী ১০ জন দেহরক্ষী নিয়ে তার চলাফেরা। রাস্তায় চলার সময় গাড়িতে উচ্চৈঃশব্দে হুটার বাজানো হয়। ভিআইপি প্রটোকলের মতোই তার গাড়িবহরে থাকে ৫-৬টি দামি গাড়ি। বহরের মাঝখানে থাকে সেলিমের কালো টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার। বিশ্বের একাধিক দেশে তার শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ। অথচ স্পা ব্যবসা ছাড়া দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস নেই তার।

গোয়েন্দারা বলেন, ঢাকার বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিক থাইল্যান্ডে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। এসব অর্থ পাচারে সহায়তা করেন সেলিম প্রধান। এছাড়া সেলিম আন্তর্জাতিক ক্যাসিনো নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত। সেলিম গত সোমবার দুপুরে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকা ত্যাগ করছিলেন। তবে শেষ মুহূর্তে তাকে বিমানের আসন থেকে নামিয়ে আনে র‌্যাবের একটি টিম। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে তার বাড়ি, অফিস এবং তার ব্যক্তিগত প্রধান কর্মকর্তার বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব।

গত সোমবার রাত ১০টা থেকে সেলিম প্রধানের গুলশান-২ নম্বরের বাড়িতে অভিযান শেষ হয় গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৪টায়। ১৮ ঘণ্টার অভিযানে ৪৮টি বিদেশি মদের বোতল, ২৯ লাখ ৫ হাজার ৫০০ নগদ টাকা, ২৩টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা যার মূল্য ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা, ১২টি পাসপোর্ট, ১২টি ব্যাংকের ৩২টি চেকবই, অনলাইন ক্যাসিনোর একটি বড় সার্ভার, ৪টি ল্যাপটপ এবং দুটি হরিণের চামড়া জব্দ করেছে র‌্যাব।

অভিযান শেষে বিকাল ৫টায় র‌্যাব সদর দফতরের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম সাংবাদিকদের জানান, র‌্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল দীর্ঘদিন ধরে ভার্চুয়াল নজরদারি চালিয়ে আসছিল। গোয়েন্দারা অনলাইন ক্যাসিনোর বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ-খবর রাখছিল। একপর্যায়ে তথ্য-প্রমাণও মিলে যায়। পরে জানা যায় সেলিম থাইল্যান্ড পালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিমানের ফ্লাইট থেকেই তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। পরে সেলিমের তথ্যে তার নিজের ও সহযোগীদের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে তার দুই সহযোগী আক্তারুজ্জামান ও রহমানকে আটক করা হয়।

র‌্যাব কর্মকর্তা সারোয়ার বিন কাশেম জানান, ১৯৭৩ সালে ঢাকায় জন্ম নেওয়া সেলিম তার ভাইয়ের হাত ধরে ১৯৮৮ সালে জাপান যান। সেখানে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন। পরে থাইল্যান্ডে শিপইয়ার্ড ব্যবসা শুরু করেন। থাইল্যান্ডে উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মিস্টার দুর সঙ্গে পরিচয় হয়। তার পরামর্শে বাংলাদেশ একটি অনলাইন ক্যাসিনো খেলার ওয়েবসাইট খোলেন। সেই সূত্র ধরে সেলিম টি-২১ এবং পি-২৪ নামে অনলাইন গেমিং সাইট চালু করেন। এর মূল কাজ হচ্ছে টাকার মাধ্যমে খেলা। কোরিয়ান মিস্টার দু এবং সেলিম এ ব্যবসার ফিফটি-ফিফটি অংশীদার।

এদিকে সেলিমকে গ্রেফতারের খবরে অনেক প্রভাবশালীর ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কারণ তার মালিকানাধীন ‘প্রধান স্পা সেন্টারে’ অনেক প্রভাবশালীর যাতায়াতের কথা শোনা যায়। গুলশানের ৩৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত এই স্পা সেন্টার ঘিরে মুখরোচক নানা কথাও আছে রাতের ধনাঢ্যপাড়ায়। সঙ্গতকারণে মাঝে মাঝেই সেখানে ভিআইপি আগন্তুকের দেখা মিলত। এ সুবাদে অনেক প্রভাবশালীর সঙ্গে তার রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। আবার অনেকেই সেলিমের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। মূলত এই অভিযোগেই তাকে বিদেশ যেতে দেওয়া হয়নি। রহস্যমানব সেলিম প্রধানের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের গাউসিয়া এলাকায়।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে সেলিমের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের তদন্ত শুরু হয়। এতে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে তার হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য উঠে আসে। এরপরই মূলত কোণঠাসা হয়ে পড়েন থাই পাসপোর্টধারী সেলিম। বিএনপি সরকারের সময় এখান থেকে প্রায় সব ব্যাংকের চেক বইসহ ব্যাংকিং দলিলপত্র ছাপানো হতো। এই প্রিন্টিং ব্যবসার নামে তিনি একাধিক ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন। জাপানের অর্থায়নে শিল্প গড়ার নামে ঋণ নেওয়া হলেও পুরো টাকাই আত্মসাৎ করা হয়। একপর্যায়ে টাকা নিয়ে দেশের বাইরে চলে যান সেলিম। তার পাঁচজন স্ত্রীর কথা শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে একজন রাশিয়ান, একজন আমেরিকান, একজন জাপানি এবং দুজন বাংলাদেশি। সেলিমের ছোট বউ বা ৫ নম্বর স্ত্রী সহকারী কাস্টমস কমিশনার। বর্তমানে কর্মরত আছেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে।

যে কারণে গ্রেফতার হলেন সেলিম : র‌্যাব জানায়, দীর্ঘদিন ধরে দেশে ভার্চুয়াল ক্যাসিনো চালিয়ে আসছিলেন সেলিম। অনলাইনে টাকা দিয়ে এগুলো খেলতে হয়। মোবাইলে সফটওয়্যার ইনস্টল করে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এটি ভিসা, মাস্টারকার্ড, বিকাশ, নগদের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করা যায়। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রেখে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। কেউ টাকা জিতলে অ্যাকাউন্টে টাকা আসবে। হারলে টাকাগুলো একটি গেটওয়ের মাধ্যমে তিনটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে চলে যেত। সপ্তাহে একদিন সব টাকা এক ব্যাংকে দেওয়া হতো।

র‌্যাব জানায়, সেলিম প্রধানের সহযোগী আক্তারুজ্জামান গেমিং সাইটটি চালাতেন এবং টাকাগুলো সংগ্রহ করে ব্যাংকে জমা করতেন। এরপর কোরীয় নাগরিক দু সে টাকাগুলো নিয়ে যেতেন। এটি সরাসরি মানিলন্ডারিং আইনের লঙ্ঘন। তাই সেলিম প্রধান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৪টি অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রথমত মানিলন্ডারিং, মাদকদ্রব্য, ফরেন কারেন্সি অ্যাক্ট এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন।

অনলাইন ক্যাসিনো থেকে আয় ৯ কোটি টাকা : সেলিম ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে প্রতি মাসে ৯ কোটি টাকা আয় করতেন। এসব টাকার অর্ধেক কোরিয়া ও অর্ধেক বাংলাদেশের যারা সম্পৃক্ত তারা পেতেন। এসব টাকা সিলন ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক এবং কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হতো বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

ক্যাসিনোর টাকা যেত লন্ডনে : অনলাইনের ক্যাসিনো থেকে অর্জিত টাকার একটি অংশ লন্ডনে যেত বলে জানিয়েছে র‌্যাব। তবে লন্ডনে কার কাছে যেত সেটি জানতে চলছে তদন্ত। র‌্যাব জানায়, সেলিম বর্তমানে কারাগারে থাকা ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলেন। তিনি মামুনকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ঠ। গিয়াস ও তারেক জিয়ার নামে সেলিম প্রধান লন্ডনে টাকা পাঠাতেন বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে বলেও জানায় র‌্যাব।

পশুর খাটাল থেকে আয় ২০ কোটি টাকা : অনলাইনের ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি পশুর খাটাল থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন সেলিম। রাজশাহীসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সীমান্তে ভারতীয় গবাদি পশুর সব খাটাল ও মাদক সিন্ডিকেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ অনলাইন ক্যাসিনো গুরু সেলিমের হাতে। এসব পয়েন্ট থেকে মাসে কম করে হলেও ২০ কোটি টাকা চাঁদা তোলেন সেলিম।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অপরাধ জগৎ,মাফিয়া,স্পা,সেলিম প্রধান,ক্যাসিনো,চাঁদা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close