জুবায়ের চৌধুরী

  ০১ অক্টোবর, ২০১৯

সম্রাট ইস্যুর সমাধান আজকালের মধ্যেই

আতঙ্কে বেনামি সম্পদশালী ও রাঘববোয়ালরা

‘অপরাধ জগতের মুকুটহীন সম্রাট’ ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট

কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই রাজধানীতে শুরু হয়েছিল ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। দেশবাসীকে চমকে দেওয়া এ অভিযান চলেছে টানা ১০ দিন। দুর্নীতি ও কালো টাকামুক্ত সমাজ গড়তে সরকার এবং প্রশাসনের সদিচ্ছার সেই অভিযানে হঠাৎ যেন বাজ পড়ল! গত তিন দিন ধরে অভিযান অনেকটাই মিইয়ে গেছে! রাজধানীতে অল্প সময়ের ব্যবধানে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগ নেতা ও টেন্ডার মোগল জি কে শামীম এবং কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ গ্রেফতার হন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও রিমান্ডে বেরিয়ে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। ক্যাসিনো-কাণ্ডে একের পর এক বেরিয়ে আসতে শুরু করে রথী-মহারথীদের নাম। যেখানেই হাত দেওয়া হয়েছে, বেরিয়ে আসতে থাকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের নাম। সবার গডফাদার হিসেবে নাম চলে আসছে তার। তদন্তে বেরিয়ে আসে ঢাকার অপরাধ জগতের মুকুটহীন সম্রাটের কাহিনি। তার সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এ ‘তিলোত্তমা নগরী’র একটি গাছের পাতাও যেন নড়ত না!

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সম্রাট গ্রেফতার হচ্ছেন শুরু থেকে এমন গুঞ্জন থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়ে চলছে নানা টালবাহানা, লুকোচুরি গল্প। চলছে ইঁদুর-বিড়াল খেলা। সম্রাটকে নিয়ে ধোঁয়াশার শুরু আছে, শেষ নেই। তাকে গ্রেফতারের দীর্ঘসূত্রতায় জনমনে বেড়েছে সন্দেহ। দিন যত যাচ্ছে সন্দেহ যেন আরো দৃঢ় হচ্ছে। একাধিকবার সম্রাটকে গ্রেফতারের গুঞ্জন ছড়িয়েছে। গত কয়েক দিন ধরেই বেশি চর্চিত হচ্ছে গোয়েন্দাজালে আটকে আছেন ক্যাসিনো গডফাদার ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। এরপর তাকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়েছে কি না সে বিষয়েও মুখ খুলছেন না কেউ। আবার তাকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি সরাসরি এমন কথাও কেউ বলছেন না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবরই সাংবাদিকদের আরো রহস্যের বেড়াজালে ফেলে দিচ্ছেন। তারা বলেন, ‘প্লিজ, ওয়েট অ্যান্ড সি’। অপেক্ষা করুন, যা ঘটবে দেখবেন।

এমন পরিস্থিতিতে সম্রাটকে আদৌ গ্রেফতার করা হবে কি না তা নিয়ে জনমনে সেই পুরোনো সন্দেহ ফের উঁকি দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে অভিযান শুরুর পর মাদক, অস্ত্র এবং মানিলন্ডারিং আইনে ১৭টি মামলা হয়েছে। প্রায় প্রতি ঘটনার সঙ্গে সম্রাটের সংশ্লিষ্টতা আছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো মামলাতেই তাকে আসামি করা হয়নি। এছাড়া সম্রাটের বিরুদ্ধে ক্যাসিনো ব্যবসা, বিদেশে অর্থ পাচারসহ আটটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও পাওয়া গেছে। তারপরও কেন থাকে গ্রেফতার দেখানো যাচ্ছে না সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযানের পর ক্যাসিনোর অবৈধ ব্যবসা দেখাশোনাকারী সম্রাটের বড় ভাই বাদল চৌধুরী এবং ছোট ভাই ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ গাঢাকা দিয়েছেন।

আতঙ্কে বেনামি সম্পদশালী ও রাঘববোয়ালরা : দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও অবৈধ সম্পদের বিরুদ্ধে অভিযান আরো জোরদার হচ্ছে। দেড় শতাধিক অসাধু মন্ত্রী-এমপি, আমলা, পুলিশ, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ বিশেষ নজরদারিতে রয়েছে। তাদের অবৈধ সম্পদের ডাটা সংগ্রহ করছে গোয়েন্দা সংস্থা। প্রাথমিকভাবে অভিযান থেমে যাবে ভাবলেও চলমান অভিযান প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে আরো জোরদার হবে এমন আশঙ্কায় দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে তার পরামর্শমতো রূপরেখা তৈরি করে অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালানো হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া অনেকেই এখন চরম আতঙ্কে। ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযান শুরুর পর গ্রেফতার আতঙ্ক ছাড়াও তাদের মধ্যে সম্পদ জব্দ হওয়ার ভীতি কাজ করছে। এরই মধ্যে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীমসহ বেশ কয়েকজনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য বের করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের সম্পদের হিসাব চেয়ে অন্তত ১০টি সংস্থাকে চিঠি দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। চিঠিতে খালেদ ও শামীমের স্ত্রী, আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের নাম রয়েছে। বৈধ উৎসের বাইরে তাদের জ্ঞাত-অজ্ঞাত সম্পদের অমিল পাওয়া গেলে তাদের সব সম্পদ জব্দ করা হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীর তালিকা করা হচ্ছে। তালিকায় নতুন নামও যুক্ত হচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের অনুসন্ধান ছাড়াও অবৈধ সম্পদ খুঁজতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কাজ করছে। গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও দুদকে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে তালিকা সমন্বয় করে তার পরামর্শ এবং রূপরেখা অনুযায়ী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দুর্নীতিবাজদের তালিকা বেশ দীর্ঘ। প্রাথমিকভাবে দুর্নীতিবাজ এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের সম্পদের হিসাব ও উৎস খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব দুর্নীতিবাজের তালিকা নিয়ে কাজ করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, দুদক ও এনবিআর। রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এ তালিকায় রয়েছে। এছাড়া টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং ক্যাসিনোর শত শত কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারার সঙ্গে রাজনীতিবিদ ছাড়াও প্রশাসনের কোন স্তরের কারা জড়িত তার অনুসন্ধান করা হচ্ছে। দেশের বাইরে কোন চ্যানেলে কীভাবে টাকা পাচার করা হয়েছে সেসব তথ্য সংগ্রহে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান গত কয়েক দিনে কিছুটা গতি হারিয়েছে। ২৫ সেপ্টেম্বরের পর গত চার দিনে দেশের কোথাও ছোট-বড় ধরনের কোনো অভিযান চালাতে দেখা যায়নি। সর্বশেষ রাজধানীর মণিপুরীপাড়ায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযান শুরু করে র‌্যাব। এরপর সারা দেশে র‌্যাব-পুলিশের অন্তত ৩৫টি অভিযানে ২৭০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুবলীগ ও কৃষক লীগের তিন শীর্ষ নেতা। তবে এখনো ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ নেপথ্যের অনেক রাঘববোয়াল অধরা রয়েছেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দুর্নীতি,অবৈধ সম্পদ অর্জন,ক্যাসিনো,ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close