নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ঢাকায় শতাধিক ক্যাসিনো : ‘রুই-কাতলারা’ও জালে আসছেন

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে চলছে শুদ্ধি অভিযান। অন্যায়কারী, দুর্নীতিবাজদের কোনোভাবে ছাড় দিতে রাজি নন তিনি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদককে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন অভিযোগ পেয়েই। গত বুধবার গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। শোনা যাচ্ছে এ তালিকায় রয়েছেন আরো অনেক ‘রাঘব-বোয়াল’, যাদের শিগগিরই গ্রেফতার করা হতে পারে।

এ লক্ষ্যে ঢাকার ৫০ থানার আট জোনের শতাধিক ক্যাসিনো বন্ধের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডিএমপির ডিসিদের। ডিএমপি ক্যাসিনো স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেবে। এর সঙ্গে জড়িত ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী, ক্যাডার, তাদের সহযোগিতা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির অসৎ কর্মকর্তাও। প্রতি রাতে এসব ক্যাসিনোয় কোটি কোটি টাকার জুয়ার আসর বসে। এতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনেকেই। ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম গত বুধবার এ কথা স্বীকার করে বলেন, রাজধানীর ক্যাসিনো স্থায়ীভাবে বন্ধের জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছি। ক্যাসিনো পরিচালনায় যুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলেছি।

ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার তৃতীয় কর্মদিবসেই ক্যাসিনোয় জুয়ার আসর চলার খবর আসে। রাজধানীর ৫০ থানার আট জোনের ডিসিকে ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িতদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মতিঝিল ও রমনা এই দুই জোনের ক্যাসিনোর সংখ্যার তালিকা পেয়ে গেছি। মতিঝিল ও রমনা এই দুই জোনে ক্যাসিনো চালানো হয় ১৭। অপর ছয় জোনের ক্যাসিনোর সংখ্যার একটি তালিকা পেয়েছি। সব মিলিয়ে রাজধানীর ৫০ থানা এলাকার আট জোনে শতাধিক ক্যাসিনোর একটি তালিকা পেয়েছি।

ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য নেপাল, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রশিক্ষিত নারীদের আনা হয়েছে। বিদেশ থেকে আনা হয়েছে প্রশিক্ষিত জুয়াড়ির পাশাপাশি নিরাপত্তা প্রহরীও। ক্যাসিনোগুলোয় প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকা উড়ছে। রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় রীতিমতো বাসা ভাড়া নিয়ে চলে এসব ক্যাসিনো। এর কোন কোনটিতে আবার জুয়াড়িদের মনোরঞ্জনের জন্য রয়েছে সুন্দরী নারীরা। ক্যাসিনোগুলোতে জুয়াড়ি ও নিজস্ব লোক ছাড়া অন্যদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির কর্মকর্তারা দৈনিক ও মাসোহারা ভিত্তিতে উৎকোচ পেয়ে থাকে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও রাজধানীতে ক্যাসিনো চালু ছিল। নিয়ন্ত্রণ করত যুবদল। তখন ক্যাসিনো বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর এলেও তেমন কোনো কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হতো না। ফলে দিনে দিনে ক্যাসিনোর সংখ্যা বেড়ে শতাধিকে পরিণত হয়েছে। এখন এই ক্যাসিনোগুলো বিএনপির যুবদলের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ করছে যুবলীগের এক শ্রেণির ক্যাডার। রাজধানীতে ক্যাসিনোর সংখ্যা কতÑ সে এরই মধ্যে তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। এই তালিকা দাখিল করা হচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ মহলে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দলীয় ফোরামের বৈঠকে বলেন, যুবলীগের মহানগরের (উত্তর-দক্ষিণ) বহু নেতা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাসিনো পরিচালনা করে আসছে। তাদের নিয়ন্ত্রণেই চলছে এসব ক্যাসিনো। এসব বন্ধ করতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট পেয়ে প্রধানমন্ত্রী এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন যে তিনি বলেছেন, যুবলীগের সবার আমলনামা আমার হাতে। সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা শতাধিক নেতার নামে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, দুর্নীতি, অনিয়মসহ বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গ্রেফতার প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে গত বুধবার যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগের তালিকায় থাকা অন্যরাও আছেন গ্রেফতারের প্রক্রিয়ায়।

ওই সূত্রগুলো আরো জানায়, শুধু যুবলীগের নেতাকর্মীই নয়, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী যাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, অস্ত্রবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়মের প্রমাণ রয়েছে তাদেরও তালিকা করা হয়েছে। এসব অভিযোগে তাদেরও গ্রেফতার করা হতে পারে। এদের ব্যাপারেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এরই মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই খবরে যুবলীগসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিজেদের অতীত কর্মকা- নিয়ে অনেকেই আতঙ্কিত। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার ক্যাসিনো ও বাসায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই যুবলীগের অনেক নেতা গা ঢাকা দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ দলের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বারবার সতর্ক করে আসছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এরপরও কয়েকজন নেতাকর্মী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থানে চলে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এসব নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। তদন্তে এসব অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছেন।

গত শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুবলীগের কিছু নেতার চাঁদাবাজি ও অপকর্মের প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শুধু যুবলীগই নয়, আওয়ামী লীগসহ অন্য সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের অপকর্ম নিয়েও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর পরেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, যুবলীগসহ অন্য সংগঠনের যেসব নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের গ্রেফতারসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আলোচিতরা গ্রেফতারের প্রক্রিয়ায় আছে। একজন গ্রেফতার হয়েছেন, আরো অনেকেই হবেন।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ক্যাসিনো,ঢাকায় ক্যাসিনো,ডিএমপি,জুয়া
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close