গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৯ জুলাই, ২০১৯

নির্মল বায়ু ও টেকসই প্রকল্পে অনিয়ম, টাকা ব্যয়ে নয়-ছয়

নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্পের পুরো টাকায় নয়-ছয় করা হয়েছে। কাজের নামে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি বিলাস, পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত নয়—এমন কাজকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্পের টাকা করা হয়েছে হরিলুট। আবার নমুনা সংগ্রহকারী থেকে কর্মকর্তাদের পাহারায় থাকা সবাইকে বিদেশ ভ্রমণে পাঠিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এমন বিদেশ ভ্রমণে পাঠানো ব্যক্তির সংখ্যা ২৯৯ জন। প্রকল্পের বড় কর্তা-বাবুরা সূদুর আমেরিকা, নরওয়ের মতো দেশে গেলেও ছোট কর্মকর্তাদের পাঠান ভারত, চীন, থাইল্যান্ডসহ পার্শ্ববর্তী দেশে। লক্ষ্য একটাই—মিলেমিশে অর্থ লুটপাট করা।

আবার এই প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে যেমন অনিয়ম করা হয়েছে। একইভাবে, এর অধীনে নেওয়া প্রশিক্ষকের বেশির ভাগ প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই চলে যান অবসরে। এমনকি, প্রকল্পের নীতি-নির্ধারকেরা নিজেদের অনিয়মকে হালাল করতে নমুনা সংগ্রহের কাজে যুক্তদের অবৈধভাবে পাঠিয়েছেন বিদেশ ভ্রমণে। এছাড়া একই ব্যক্তি ঘুরে ফিরে প্রশিক্ষণের নামে গেছেন বিদেশ ভ্রমণে। কোনো কোনো কর্মকর্তা প্রায় এক ডজন বার গেছেন বিদেশ ভ্রমণে। এই প্রকল্পে কর্মকর্তাদের পাহারায় থাকা পুলিশ কর্মকর্তাও বাদ যাননি বিদেশ ভ্রমণ থেকে। আর পুরো প্রকল্পের অর্ধেক টাকা ব্যয় করা হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতার পেছনে। যার পরিমাণ ১৮২ কোটি টাকা। পাশাপাশি বিদেশ ভ্রমণের পেছনে ব্যয় হয়েছে এক-তৃতীয়াংশের বেশি অর্থ।

এদিকে, প্রকল্পের মেয়াদ গত জুনে শেষ হলেও নতুন করে মেয়াদ বাড়াতে তৎপর হয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এর আগে একদফা মেয়াদ বাড়ানো হয়। অর্থাৎ এই প্রকল্পের মেয়াদ শুরু হয় ২০০৯ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালের জুনে। পরে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৯ সাল নির্ধারণ হয়।

কেইস প্রকল্পের এই অনিয়ম দেখে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ক্ষোভ জানিয়ে বলেছে, এভাবে প্রকল্প নিলে সরকারের যে মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই দেখা যায় তারা অবসরে চলে গেছেন। ফলে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও প্রকল্পের উন্নয়নে কোনো কাজ হয়নি। এর জন্য বিশেষজ্ঞদের আগামীতে প্রকল্পে যুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে অনেক বেশি ফলপ্রসু হবে। এতে আর্থিক খরয় যেমন কমবে। একই সঙ্গে প্রকল্পের কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে।

তিনি আরো বলেন, এই প্রকল্পের যারা পরিবেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন না তাদেরও যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো অনিয়ম ও দুর্নীতিতে প্রশয় দেওয়ার শামিল। তাই প্রকল্পের প্রকৃত কাজের মূল্যায়ন হয়েছে কিনা তা পুনর্মূল্যায়নের জন্য পুনরায় আইএমইডিকে দিয়ে যাচাই করার জন্য কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ জানানো হয়েছে।

নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রশিক্ষণের নামে একই ব্যক্তি ঘুরে ফিরে গেছেন বিদেশে। এমনি একজন শাহ রেজোয়ান হায়াত। এই ব্যক্তি প্রকল্প মেয়াদে ১১ বার বিদেশে গেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছরই প্রশিক্ষণের নামে তিনি বিদেশ ভ্রমণে যান। এই প্রকল্পের তিনি উপপ্রকল্প পরিচালক। কম যাননি প্রকল্প পরিচালক নাসিরুদ্দিনও। তিনি গেছেন প্রশিক্ষণের নামে একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণে। এছাড়া শামসুর রহমান খানও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কয়েকবার গেছেন বিদেশে। তাদের সঙ্গে প্রতিবারই ভ্রমণের সুবিধা নিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মঞ্জুরুল হান্নান। একই সঙ্গে পিডি হিসেবে তিনি প্রকল্পের তিনটি গাড়ি একাই ব্যবহার করেছেন। এছাড়া কাজী মনিরুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, শাহানাজ রহমান, নীল রতন সরকারসহ ২৯৯ জন ব্যক্তি অবৈধভাবে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। এতে সরকারের যতটা লাভ হয়েছে কর্মকর্তাদের বেশি পকেট ভারি হয়েছে বলে মনে করছে সংসদীয় কমিটি। এর মধ্যে সিটি মেয়র, কাউন্সিলর, সিটির কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের ওসি থেকে কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা এ তালিকায় রয়েছেন।

এদিকে প্রকল্পের অধীন ৩১টির সব গাড়ি নতুন কেনা হলেও বেশির ভাগ মেয়াদের আগেই অচল দেখানো হয়েছে। অথচ ১০ বছরে ৯টি গাড়ি বিকল হয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। এসব গাড়ির মধ্যে মাইক্রোবাস, পিক আপ, মোবাইল মনিটরিং ভ্যান ও জীপ রয়েছে। আবার সচল গাড়ির অবস্থাও শোচনীয়।

প্রকল্পের সঙ্গে যুক্তদের মধ্যে বেশির ভাগ কর্মকর্তা মেয়াদ উত্তীর্ণের আগেই অবসরে গেছেন। এমন কর্মকর্তাদের মধ্যে আনছার আলী খান, ব্রি. জে. আবদুল কাদির, ব্রি. জে. আহসানুল হক মিয়া, মো. নুরুল্লাহ, আবদুস সালাম, সেহাব উল্লাহ, মফিজুল ইসলাম প্রমুখ।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কেইস,নয়-ছয়,প্রকল্প,অর্থ লুটপাট,অনিয়ম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close