জুবায়ের চৌধুরী

  ২০ এপ্রিল, ২০১৯

ফেঁসে যেতে পারেন পুলিশসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা

*গভর্নিং বডি ও এসপি-ওসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ *দীর্ঘ হচ্ছে ঘটনায় জড়িতদের তালিকা

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ফেঁসে যেতে পারেন স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা এবং গভর্নিং বডির বেশ কয়েকজন সদস্য। তাদের অনেকেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে নুসরাত হত্যায় জড়িত কিংবা ঘটনা জেনেও কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখেননি।

স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন যথাযথ ভূমিকা নিলে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা এড়ানো যেত বলে পুলিশ সদর দফতরের তদন্ত কমিটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের অভিমত, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর থেকে নুসরাত হত্যা পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন দরকারি ভূমিকা পালন করেনি।

দীর্ঘ হচ্ছে জড়িতদের তালিকা : নুসরাত হত্যার ঘটনায় জড়িতদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। ঘটনার পরিকল্পনা, কিলিং মিশন বাস্তবায়ন, খুনে অর্থ ব্যয়সহ নানাভাবে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৫ জনের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে। এ তালিকা আরো বাড়তে পারে। শিগগিরই চাঞ্চল্যকর এ মামলার চার্জশিট দাখিল করবে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

সংস্থাটির প্রধান ও ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত এগিয়ে চলছে। যাদের এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। আর পিবিআই চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান এসপি মোহাম্মদ ইকবাল জানান, নুসরাত হত্যা মামলায় চারজন আসামির জবানবন্দিতে ২৪-২৫ জনের নাম এসেছে। এখন তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সব আসামিকে গ্রেফতার করা হবে। এখন পর্যন্ত ১৮ জন গ্রেফতার হয়েছে।

এদিকে পুলিশ সদর দফতরের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ডিআইজি এস এম রুহুল আমিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, অধ্যক্ষ সিরাজের চারিত্রিক বিভিন্ন বিষয় তদন্তে উঠে এসেছে। আগেও এ রকম কিছু সমস্যা ছিল। তখন যদি গভর্নিং কমিটি ব্যবস্থা নিত, তাহলে এ ঘটনা ঘটত না। তিনি বলেন, গভর্নিং কমিটির সবাই নয়, কিছু সদস্য নুসরাত হত্যায় জড়িত ছিল। নুসরাত হত্যায় স্থানীয় রাজনীতিও জড়িত। তবে যে-ই জড়িত থাকুক, তাকে গ্রেফতার করা হবে। তদন্ত কমিটি গতকাল সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য নিয়েছে। রুহুল আমিন আরো জানান, ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। নুসরাত হত্যার ঘটনায় ওসির কোনো গাফিলতি বা দায়িত্বে অবহেলা থাকলে, অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তদন্ত শেষ হতে তিন-চার দিন সময় লাগবে।

ফেঁসে যাচ্ছেন শিক্ষক, গভর্নিং বডির সদস্যসহ এসপি-ওসিও : নুসরাতের শরীরে আগুন দেওয়ার ঘটনার পরও ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকার এবং সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের আচরণ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের আচরণে পেশাদারত্বের ন্যূনতম ছাপ ছিল না। উল্টো নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে প্রচারের চেষ্টা ছিল তাদের। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ডিআইজি এস এম রুহুল আমিনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা সোনাগাজীতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। কমিটির সংশ্লিষ্টরা জানান, যৌন হয়রানির অভিযোগ করার পর ওসি মোয়াজ্জেম যেভাবে নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, সেটা যথাযথ হয়নি। ভুক্তভোগী নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাটিও নজিরবিহীন। এ ঘটনার যথাযথ তদন্ত শেষে এসপি ও ওসির ভূমিকা এবং স্থানীয় পুলিশের কোনো সদস্যের গাফিলতি ছিল কি না—সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত ও প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

তদন্ত কমিটির প্রধান ও পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি এস এম রুহুল আমিন জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত শিক্ষক, গভর্নিং বডি, নুসরাতের পরিবারসহ ১৫ জনের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বহিষ্কৃত অধ্যক্ষ সিরাজের আরো অনেক অপকর্মের তথ্য মিলেছে। আগে ব্যবস্থা নিলে নুসরাতের ঘটনাটি এড়ানো যেত। মাদরাসা গভর্নিং বডির গাফিলতি আছে। সবকিছুরই তদন্ত হচ্ছে। এসপি ও ওসিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

এদিকে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় একাধিক আসামির জবানবন্দিতে নাম আসা সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে আটক করেছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। এ ছাড়া নুসরাত হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবিতে ঢাকা থেকে সোনাগাজীর উদ্দেশে একটি রোডমার্চের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোট এ রোডমার্চের ঘোষণা দেয়।

বেরিয়ে আসছে অধ্যক্ষ সিরাজের কুকীর্তি : ২০০১ সালের ১ জুন অভিজ্ঞতার জাল সনদ দিয়ে উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সিরাজের ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অপকর্মের পথচলা। জামায়াতের রোকন থেকে ২০১৬ সালে বহিষ্কৃত হলেও সব আমলেই তার অপকর্ম অব্যাহত রাখেন আজ্ঞাবহ ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রুহুল আমিন সহসভাপতি হওয়ার পর অধ্যক্ষের অপকর্ম বেড়ে যায়। যৌন নিপীড়নের বিচার চাওয়ায় গত অক্টোবরে এক ছাত্রীর পরিবারকে হয়রানির মুখে পড়তে হয়। আর প্রতিবাদ করায় প্রাণ দিতে হয় নুসরাতকে।

২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর আলিম দ্বিতীয় বর্ষের আরেক ছাত্রীকে নিপীড়ন করেন অধ্যক্ষ সিরাজ। লজ্জা ও অপমানে ওই ছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে ওই ছাত্রীর বাবা মাদরাসার গভর্নিং বডির সভাপতির কাছে লিখিতভাবে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন। ওই অভিযোগের অনুলিপি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান ও গভর্নিং বডির অন্য সদস্যদেরও দেওয়া হয়। কিন্তু অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে যাননি গভর্নিং বডি ও স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। বারবার গুরুতর অভিযোগ উঠলেও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় নুসরাতের ওই পরিণতি হয়েছে।

অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে ১২টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরে প্রতিকার চেয়ে সংশ্লিষ্টদের চিঠি পাঠিয়েছিলেন মাদরাসার ১৬ শিক্ষক। কিন্তু তাদের সেই অভিযোগ আমলে আসেনি কখনো। উল্টো ওইসব শিক্ষককে নানাভাবে হয়রানি করেছেন অধ্যক্ষ সিরাজ। অভিযোগে উঠে আসে, কোনো শিক্ষকের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যাপারে মতানৈক্য হলেই সঙ্গে সঙ্গে ওই শিক্ষককে শোকজ, বেতন কর্তন, চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিতেন অধ্যক্ষ। বিভিন্ন শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রী ভর্তি, ফরম পূরণ, উপবৃত্তিসহ আর্থিক সব লেনদেন নিজেই করতেন তিনি। এসবের প্রতিবাদ করলে শিক্ষককে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতেন যেন তার অপকর্ম ধরা না হয়। মাদরাসায় আসা মানতের ও লিল্লাহ বিভাগের পশু বিক্রি করে সে টাকাও নিজের পকেটে ভরতেন। কোনো আয়-ব্যয়ের হিসাবও দিতেন না তিনি। এসব কাজে গভর্নিং বডির পূর্ণসহায়তা পেয়েছেন তিনি। আর তাই নির্বিঘ্নে হরিলুট করেছেন অধ্যক্ষ সিরাজ।

গত ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। কয়েকজন তাকে কৌশলে ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন মারা যান অগ্নিদগ্ধ নুসরাত। এর আগে ২৭ মার্চ ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন। এদিকে নুসরাত হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ১৮ জনকে। এদের মধ্যে এজাহারভুক্ত আটজনই গ্রেফতার হয়েছে। আর আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে চারজন। সবশেষ গতকাল সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি রুহুল আমিনকেও আটক করা হয়।

রিমান্ডে থাকা মণিকে নিয়ে ঘটনাস্থলে পিবিআই : ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় সহপাঠী কামরুন্নাহার ওরফে মণিকে নিয়ে ঘটনাস্থল ও বোরকার দোকান পরিদর্শন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গতকাল শুক্রবার দুপুরে পিবিআইয়ের একটি দল রিমান্ডে থাকা মণিকে নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে।

পিবিআইয়ের দলটি সোনাগাজী মাদরাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সেখানে নুসরাতকে কীভাবে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তার বিবরণ দেন মণি। মো. শাহ আলম আরো বলেন, গ্রেফতার হওয়া মণির কাছ থেকে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া পুরুষদের গায়ে থাকা বোরকাগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
স্থানীয় প্রভাবশালী,পুলিশ,নুসরাত হত্যা,তদন্ত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close