জুবায়ের চৌধুরী

  ৩১ অক্টোবর, ২০১৮

কারাগারে কঠোর নজরদারি

সম্প্রতি এক জেলারকে মাদকসহ গ্রেফতারের পর নড়েচড়ে বসেছে কারা অধিদফতর। কারাগারে মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা এবং কঠোর নজরদারি শুরু হয়েছে। দেশের সব কারাগারের যেকোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বন্দির বিরুদ্ধে মাদক বিক্রি, সেবন বা পরিবহনের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যদিও আগে থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে চলছিল কারা কর্তৃপক্ষ।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস মাদকসহ গ্রেফতার হওয়ার পর আবারো কারা অধিদফতর থেকে সব কারাগারের জেল সুপার ও জেলারদের প্রতি সর্বোচ্চ নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে হিসাবে কারা প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা ছাড়াও মাদক মামলায় দেশের কারাগারগুলোতে বন্দি থাকা ৫০ হাজার হাজতি ও কয়েদি কঠোর নজরদারির আওতায় রয়েছেন, এরা জেলাখানায় মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহভাজন।

কারাসূত্র জানায়, কারাগারে মাদক প্রবেশ কঠোরভাবে রোধ করতে কারাগারে স্থাপিত বডি স্ক্যানার বা আর্চওয়ে গেট দিয়ে বন্দিদের তল্লাশির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে সবার ব্যাগ পরীক্ষা ছাড়াও সন্দেহজনক বন্দিকে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রয়োজনে একাধিকবার পরীক্ষারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কারাগারে শিফট পরিবর্তনের সময় কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শরীর তল্লাশির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, কারাগারের মাদক প্রবেশের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এমন কারারক্ষী থেকে শুরু করে হাবিলদার, সুবেদার সার্জেন্ট, ডেপুটি জেলার, জেলার এমনকি জেল সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিশেষ নজরদারিতে রাখছে কারা অধিদফতর। এজন্য কারা গোয়েন্দাসহ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য যাচাই করে তাদের নিয়মিত কর্মকান্ডের ওপর চলছে নজরদারি। গত কয়েক মাস ধরে মাদকের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজ চললেও বর্তমানে তা আরো কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, মাদকের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এমন কারো তথ্য প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিক সাময়িক বরখাস্ত করা, হাতেনাতে ধরতে পারলে পুলিশে ধরিয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে। এর বাইরে মাদক ব্যবসা, সেবন বা পরিবহনসহ মাদকের মামলার আসামিদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের সঙ্গে জড়িত যেকোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধেও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কারা অভ্যন্তরে কোনো কর্মচারী বা কর্মকর্তা কোনো ধরনের মাদক সেবন, পরিবহন বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে কিনা তার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে কারা গোয়েন্দা কতৃক পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়ার পর তালিকা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয় তথা সরকারের সর্বোচ্চ মহলে সুপারিশ পাঠানো হবে। এরপর দোষীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবে কারা অধিদফতর।

জানা গেছে, আটকের পর নেশাগ্রস্ত প্রায় সব বন্দিই মাদক সেবনের জন্য প্রতিদিনই কারাগারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন উপায়ে মাদক প্রবেশ করাতে চেষ্টা করেন। বর্তমানে কারাগারে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তবে বেশ কিছু বন্দি গাঁজা সেবন করতেও দেখা গেছে। বর্তমানে কারাগারে বন্দির বিরুদ্ধে মাদকাসক্ত বা মাদক বহনে যুক্তসহ মাদক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হলে জেল সুপারের নির্দেশে বন্দিদের ডান্ডাবেড়ি, আরওয়া বেড়ি পড়ানো, ওয়ার্ড থেকে সরিয়ে সেলবাস দেয়া হয়। এছাড়া স্ট্যান্ডিং হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেওয়া, সশ্রম দন্ড ভোগের মাধ্যমে কাজের পদাবনতি দেওয়াসহ সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ক্ষেত্রবিশেষ কোনো কোনো আসামিকে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারেও স্থানান্তর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

কারা সূত্র জানায়, স্বাভাবিক পন্থায় কারাগারে মাদক ঢুকানো কঠিন হওয়ায় সেবনকারী বা বহনকারী জুতার ভেতর থেকে শুরু করে পলিথিনে ভরে ইয়াবা খেয়ে পেটের ভেতর করে আনা, গোপনাঙ্গে লুকিয়ে ইয়াবা আনা, শার্ট ও লুঙ্গির ভেতর সেলাই করে বা লুঙ্গিতে গোপন পকেট তৈরি করে, বাইরে থেকে খাবার আনার সময় টিফিন বক্সের ভেতরে করে কারা অভ্যন্তরে মাদক সরবরাহ করার চেষ্টা করে থাকে। এছাড়া বন্দিকে সরবরাহ করা শুকনো খাবারের সঙ্গেও কারাগারে মাদক পাচারের ঘটনা ঘটে থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদালত ফেরত আসামিরাই কারাগারে মাদক ঢোকানোর চেষ্টা করেন বেশি। আর এতে সাহায্য করেন অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

দেশের প্রায় সব কারাগারেই কমবেশি মাদক মামলার আসামি বন্দি আছে। তবে সবচেয়ে বেশি মাদক আসামি থাকছেন ঢাকা, কক্সবাজার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহী, যশোর, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, বরিশালসহ বেশ কয়েকটি বড় বড় কারাগারে। মাদকাসক্ত এসব বন্দি কারা অভ্যন্তরে মাদক হাতে পেতে এমন কোনো চেষ্টা নেই যা করেন না। সময়মতো মাদক সেবনের জন্য মোটা অংকের অর্থ দিতেও কার্পণ্য করেন না। এর ফলে নিরাপত্তারক্ষীরা বিভিন্ন কৌশলে কারাগারে মাদক ঢোকাতে তাদের সহায়তা করছে।

গত কয়েক বছরে কারা অভ্যন্তরে মাদক ঢোকাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন প্রায় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। সবার বিরুদ্ধেই বিভাগীয় শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। কারো কারো পদোন্নতি স্থগিত, বেতন বন্ধ, ইনক্রিমেন্ট স্থগিত, সঙ্গে সঙ্গে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। এছাড়া মাদকসংক্রান্ত অভিযোগ তদন্ত করার পর চাকরি থেকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্তও হয়েছেন বেশ কয়েকজন। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, শাস্তি পাওয়ার পর তারা আদালতের মাধ্যমে ফের চাকরিতে বহাল হচ্ছেন। তারপরও মাদকের বিষয়ে কাউকেই ছাড় দিতে রাজি নয় কারা অধিদফতর।

এ বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জানান, কারাগারের ভেতরে কোনোক্রমেই যেন মাদক প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য কারাগারে দায়িত্বরতদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কারাগারের যেকোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বন্দিসহ কারা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি মাদক বিক্রি, সেবন বা পরিবহন করলে সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে কারাবিধি অনুযায়ী শাস্তি হচ্ছে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। কারা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে বিভাগীয় মামলা ছাড়া প্রচলিত আইনেও নিয়মিত মামলা করা হচ্ছে।

আইজি প্রিজন্স বলেন, বর্তমানে দেশের ৬৮টি কারাগারে ৫০ হাজারেরও বেশি বন্দি মাদক সংশ্লিষ্ট মামলায় আটক রয়েছেন। তারা তো চাইবেন কারাগারে বসেই মাদক সেবন করতে। আদালত থেকে আসা নতুন ও পুরাতন বন্দিরা এমনকি তাদের দেখা করতে আসা স্বজনরাও কৌশলে কারা অভ্যন্তরে মাদক ঢোকানোর চেষ্টা করেন। অর্থের লোভে কারা অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও তাদের সহায়তা করে থাকেন। তবে কারা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখন তো কঠোর নজরদারিতে আছেন কারা সংশ্লিষ্টরা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাদক,কারাগার,নজরদারি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close