জুবায়ের চৌধুরী

  ২৩ অক্টোবর, ২০১৮

কুরিয়ার পার্সেলের আড়ালে চলে হুন্ডি-মাদকের কারবার!

দেশের কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। কুরিয়ারে পার্সেলের আড়ালে চলছে হুন্ডি-মাদকের কারবার। অপরাধীরা নিরাপদ ভেবেই কুরিয়ার সার্ভিসকে ব্যবহার করছে। এ কাজে কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী সরাসরি জড়িত। গত কয়েক মাস ধরে চলা মাদকের বিরুদ্ধে টানা অভিযানের মধ্যেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় পৌঁছে যাচ্ছে মাদকদ্রব্য। সন্দেহের তীর দেশের কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর দিকে, বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক পার্সেল করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছু চালান ধরাও পড়লেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

কুরিয়ার সার্ভিসে কোনো পণ্য পাঠানোর আগে ভালো করে যাচাই করার কথা থাকলেও কুরিয়ার কোম্পানিগুলোর কিছু অসাধু কর্মচারী ও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে মাদক পাচার বন্ধ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কুরিয়ার সংশ্লিষ্ট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত এক বছরে চট্টগ্রাম, ফেনী, কক্সবাজার, ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালে অন্তত অর্ধশত কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ইয়াবা চালান জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব ঘটনায় প্রাপক গ্রেফতার হলেও প্রেরক সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে। প্রেরকদের ঠিকানাগুলোও থাকে ভুয়া। আর তাই মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে খুঁজলেও প্রেরককে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

গত ২৭ আগস্ট রাজধানীর মতিঝিলে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ৪০ হাজার পিস ইয়াবা রিসিভ করার সময় র‌্যাব-১০ এর অভিযানে ধরা পড়ে চার ইয়াবা চোরাকারবারি। আটক চারজন হলো আরিফ, ফোরকান, রুবেল ও আবু নাইম। তারা কক্সবাজার থেকে পাঠানো ইয়াবা মতিঝিলে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে রিসিভ করতে এসে গ্রেফতার হয়। ক্রিমের কৌটায় করে ইয়াবাগুলো ঢাকায় আনা হয়েছিল। র‌্যাব-১০ জানায়, ইয়াবাগুলো পাঠানো হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। প্যারাশুট ও ভাটিকা কসমেটিক্সের কৌটার মধ্যে কৌশলে ইয়াবার প্যাকেট রেখে পাচার করা হয়েছিল। প্রতিটি কৌটায় রাখা হয়েছিল ১ হাজার পিস ইয়াবা। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব সদস্যরা আগে থেকেই কুরিয়ার অফিসের সামনে অবস্থান নেন এবং ইয়াবার ওই চালান গ্রহণ করার সময় হাতেনাতে চারজনকে আটক করেন তারা।

সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, চোরাকারবারিরা নানা পণ্যের আড়ালে মাদকের চালান পাঠিয়ে থাকে। টেলিভিশন, ল্যাপটপসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের মধ্যে মাদক ভরে তারপর পাচার করে। এসব পণ্য কখনো আমাদের এজেন্টরা খুলে দেখতে পারে না। আর তাই কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের অজান্তেই নিরাপদে মাদক পাচার হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে কুরিয়ারের কর্মী বা তাদের এজেন্টরা মাদক পাচারে জড়িত। এর জবাবে দেলোয়ার হোসেন বলেন, সারা দেশে আমাদের পাঁচশ’র বেশি এজেন্ট ও ব্রাঞ্চ আছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে, তাদের এজেন্ট থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চাকরিজীবী হলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে।

কুরিয়ারে মাদক পাচারের বিষয়ে র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি কাইয়ুমুজ্জামান বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসকে মাদক পাচারের একটা নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে চোরাকারবারিরা। তবে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি কুরিয়ার সার্ভিস সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হলে কুরিয়ারে মাদক পাচার বন্ধ করা সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।

জানা গেছে, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ইয়াবা সাধারণত কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ল্যাপটপ, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্য, কসমেটিকস ও কাপড়ের আড়ালে নির্দিষ্ট গন্তব্যের জন্য এন্ট্রি করা হয়। ভুয়া প্রেরকের নাম দিয়ে এন্ট্রি করে এসব চালান পাঠানো হয়। সেই পণ্য ডেলিভারি নেওয়ার জন্য কখনো কখনো গন্তব্যে নির্ধারিত লোক আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। আবার কখনো কখনো যে বা যারা কুরিয়ারে পাঠায় তারাই বাস, ট্রেন বা বিমানযোগে রাজধানীতে এসে সেগুলো গ্রহণ করে চোরাকারবারিদের কাছে পৌঁছে দেয়। মাদক বিক্রির টাকা নিয়ে আবার তারা ফিরেও যান।

কুরিয়ার সার্ভিসে হুন্ডি : সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাচার ও অবৈধ লেনদেনে বাড়তি নজরদারি আরোপের ফলে হুন্ডিবাজরা বিকল্প পথ হিসেবে কুরিয়ার সার্ভিসকে ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে তারা দেশের ভেতর ও বাইরে অর্থ স্থানান্তর করছে বেআইনিভাবে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহনসহ নানা মাধ্যম ব্যবহার করে এই চক্রটি হুন্ডি কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে প্রায় অর্ধশত কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সারা দেশেই তাদের শাখা রয়েছে। সব শাখার মাধ্যমেই তারা টাকা স্থানান্তর করে। এ প্রক্রিয়ায় শুধু একটি মোবাইল ফোন নাম্বারের ভিত্তিতে টাকা স্থানান্তর হয়ে যায়। ফলে লেনদেনের কোনো রেকর্ড থাকে না। যে কারণে অপরাধী চক্রটি টাকা স্থানান্তরের জন্য এই পথটি বেছে নিয়েছে।

আবার দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অর্থ স্থানান্তর সম্পর্কিত আইন রয়েছে দুইটি। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এবং ডাকঘর আইন ১৮৯৮। এই দুইটি আইন অনুযায়ী কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি অর্থ স্থানান্তর করতে পারে না। ডাকঘর আইনের আওতায় সর্বশেষ মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস বিধিমালা করা হয় ২০১৩ সালে। এতেও অর্থ স্থানান্তরের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই অবৈধভাবে টাকা স্থানান্তর করছে। এ বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা চলছে।

কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ সংগঠনের দাবি, বহু দিনের চেষ্টায় জনসাধারণ তথা গ্রাহকদের মধ্যে একটা বিশ্বস্ততার জায়গা তৈরি করেছে কুরিয়ার সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্বস্ততার কারণেই তারা ব্যবসা করে যাচ্ছে। পোস্ট অফিস আইন ও অর্থ পাচার আইনে শুধু অবৈধ স্থানান্তরের বিষয়ে বলা হয়েছে। কুরিয়ার সার্ভিসগুলো কোনো ধরনের অবৈধ অর্থ স্থানান্তর করে না। সম্প্রতি কাকরাইল ও নিউমার্কেটে দুইটি কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, কুরিয়ারের মাধ্যমে টাকা লেনদেনের জন্য আলাদা একটি স্থান রয়েছে। এখানে অন্যান্য শাখার চেয়ে ব্যস্ততা ও ভিড় বেশি।

এর বাইরে মোটা অঙ্কের অর্থ নগদ আকারে স্থানান্তর করছে বিভিন্ন গণপরিবহন। তাদের কাউন্টারে নগদ টাকা জমা দিলে তারা ওই অর্থ গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়। তবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আদলে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর দ্রুত হওয়ায় গণপরিবহনের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর কমে গেছে। এদিকে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করতে গেলে গ্রাহকের হিসাব থাকতে হবে। এছাড়া ফরম পূরণের ক্ষেত্রে দিতে হবে নানা তথ্য। টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার (টিটি), ডিমান্ড ড্রাফট (ডিডি), মানি ট্রান্সফারের (এমটি) মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করতে গিয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় অনেক ব্যাংককে জরিমানা গুনতে হয়েছে। যে কারণে ব্যাংকগুলো এখন টিটির মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করতে চায় না। মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রমে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের ফলে এর মাধ্যমেও অর্থ স্থানান্তর কমে গেছে। ফলে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এখন অর্থ স্থানান্তর বেশি হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়া রহমান বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসের মতো সহজে টাকা স্থানান্তরে ঝুঁকিপূর্ণ মাধ্যমগুলো এখনই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কেননা বর্তমানে জঙ্গিবাদ ও অন্যান্য অপরাধের আর্থিক উৎসগুলো নিরূপণ করা না গেলে এর বিস্তৃতি ঘটবে। এক্ষেত্রে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর হলে তার কোনো উৎস পাওয়া যাবে না।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাদক,হুন্ডি,কুরিয়ার,পার্সেল
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close