শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম

  ১৯ জুলাই, ২০১৮

ভুয়া ঠিকানার পাসপোর্টধারী চট্টগ্রামের মাফিয়া ইউছুফ

চট্টগ্রাম নগরের সবচেয়ে বড় মাদক আখড়া বরিশাল কলোনির নিয়ন্ত্রক মো. ইউছুফ। তার বিরুদ্ধে রয়েছে কমপক্ষে ২৭টি মামলা। সব মামলায় তার স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লার দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ ও বর্তমান ঠিকানা চট্টগ্রাম নগরের সদরঘাট থানার কদমতলী। কিন্তু এই মাদক সম্রাট চট্টগ্রামের পটিয়ার নন্দিরখীলের স্থায়ী বাসিন্দা পরিচয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পেয়ে গেছেন পাসপোর্ট। অভিযোগ আছে, ভুয়া ঠিকানার এই পাসপোর্ট থাকায় দেশের বাইরে যাতায়াত করার সময় ইউছুফ ইমিগ্রেশনে ধরা পড়ছেন না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শীর্ষ মাদক কারবারি মো. ইউছুফের পাসপোর্টের নম্বর- বিবি ০৭০৩৮৬১। ২০১৪ সালের ২৪ জুলাই তাকে পাসপোর্টটি দেয় কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কথা রয়েছে পাসপোর্টের। এতে বাবার নাম মো. চারু মিয়া ও মায়ের নাম ফাতেমা বেগম এবং স্ত্রীর নাম ইয়াসমিন আক্তার জুলি উল্লেখ আছে। পাসপোর্টে ঠিকানা হিসেবে শুধু উল্লেখ আছে নন্দিরখীল, পটিয়া, চট্টগ্রাম। কার বাড়ি, কোন ওয়ার্ড-ইউনিয়ন কিছুই সেখানে নেই। নন্দিরখীল গ্রামটি পটিয়ার ধলঘাট ইউনিয়নের অধীনে পড়েছে; সেখানে তার বাসাবাড়ি কিছুই নেই বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়।

এই পাসপোর্টটি করতে ইউছুফ জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করেছেন। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম মাদারবাড়ী, বায়তুল জান্নাত মসজিদ লেইন ঠিকানায় জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন ইউছুফ। পাসপোর্টে থাকা বাবা-মায়ের নাম একই আছে জাতীয় পরিচয়পত্রে; তবে স্ত্রীর নাম উল্লেখ আছে মোছাম্মৎ জুলি আক্তার। বর্তমানে ইউছুফের কাছে থাকা পাসপোর্টটিতে দেখা যায়, তার নামে আগেও একবার পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছিল; পুরনো পাসপোর্টটির নম্বর সি ১৯১৯৩১৬। পাসপোর্ট-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য পাসপোর্ট অফিসে যাচাই করে দেখেছেন এ প্রতিবেদক।

জানা যায়, কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার ইলিয়টগঞ্জের মোবারকপুর মুন্সীবাড়ি গ্রামের চারু মিয়া অল্প বয়সে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে এসে কুলির কাজ নেয়। বাবার সহযোগী হিসেবে কুলির কাজের পাশাপাশি রেলস্টেশন-সংলগ্ন এলাকায় ছিঁচকে চুরি ও ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে মো. ইউছুফ। একপর্যায়ে কুলির কাজ ছেড়ে ২০১০ সাল থেকে মাদক ব্যবসা শুরু করে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তথ্যমতে, মাদক ব্যবসা করেই সে ১৫০ কোটি টাকার মালিক। সদরঘাট থানাধীন কদমতলী পুড়া মসজিদসংলগ্ন সাত গন্ডা জমির ওপর বহুতল ভবন করেছে ইউছুফ। সেখানে ইউছুফের স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যরা থাকে। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ২৭টি মামলার খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৩টি মামলা হয়েছে ডবলমুরিং থানায়, সদরঘাট থানায় ৮টি, কোতোয়ালি থানায় চারটি এবং চান্দগাঁও ও চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানায় একটি করে মামলা আছে ইউসুফের বিরুদ্ধে।

এ ধরনের একজন শীর্ষ মাদক কারবারির অনায়াসে পাসপোর্ট পেয়ে যাওয়া, তাও আবার বুয়া ঠিকানায়Ñ এটা অবাক করার মতো ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘দেশের একজন প্রকৃত নাগরিক চাইলেই পাসপোর্ট পান না। অনেক যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে ভুল ঠিকানায় মাদক কারবারির পাসপোর্ট পাওয়ার খবরটি আমাদের উদ্বিগ্ন করে। তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক মো. আল আমিন মৃধা বলেন, একজন বাংলাদেশি নাগরিককে পাসপোর্ট পেতে হলে জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নানা তথ্য-প্রমাণ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করতে হয়। এরপর সেই তথ্য-উপাত্ত সঠিক কি না, তা যাচাই করে থাকে পুলিশ বিভাগের বিশেষ শাখা। পুলিশের কাছ থেকে আপত্তি পেলে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় না।

ভুল ঠিকানায় ইউছুফের পাসপোর্ট পাওয়ার তথ্য শুনে বিস্মিত হন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা; তিনি অবাক হয়ে বলেন, ‘এটা কী করে সম্ভব? তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ প্রতিবেদকের কাছে পাসপোর্টের একটি কপি থাকার বিষয়টি জানার পর তাৎক্ষণিক চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) মহিউদ্দিন মাহমুদ সোহেলকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা।

জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মাহমুদ সোহেল বলেন, তথ্য গোপন করে ইউছুফের পাসপোর্ট নেওয়ার বিষয়টি তদন্ত হবে। পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ করে পাসপোর্টটি বাতিল করা হবে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮০ সালে রেলওয়ের জায়গায় গড়ে ওঠে নগরের সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া বরিশাল কলোনি। এ কলোনির নিয়ন্ত্রক ফারুক ওরফে বাইট্যা ফারুক ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ফারুকের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন ইউছুফ। ফারুকের মৃত্যুর পর বরিশাল কলোনির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইউছুফের কাছে।

র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের মুখপাত্র ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক মিমতানুর রহমান বলেন, ‘পাসপোর্ট থাকলেও ইউছুফ বৈধপথে দেশের বাইরে যাওয়া-আসা করেন না। তার ছবিসহ সব তথ্য আমরা বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোতে দিয়ে রেখেছি। বৈধ পথে সে যাচ্ছে না, অবৈধ পথে ভারতে যাওয়া-আসা করে।’

বিমানবন্দরের ভেতরে বিমান পেছনে রেখে ইউছুফের একটি ছবি পুলিশের কাছে থাকার কথা তুলে ধরা হলে র‌্যাব কর্মকর্তা মিমতানুর রহমান বলেন, ‘এই ছবি হয়তো অনেক আগের। এখন তাকে ধরার জন্য আমরা তৎপর আছি।’

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাদক সম্রাট,চট্টগ্রাম,বরিশাল কলোনি,চট্টগ্রামের মাফিয়া ইউছুফ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist