জুবায়ের চৌধুরী

  ১৮ জুলাই, ২০১৮

বিদেশ ও জেল থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ

বিদেশে বসেই ঢাকায় তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে যাচ্ছে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। তাদের ‘বেতনভুক্ত’ সন্ত্রাসীদের দিয়ে চাঁদাবাজির পাশাপাশি কিলার দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। চাঁদাবাজির টাকা অনায়সেই চলে যাচ্ছে বিদেশে। দেশে সক্রিয় তাদের এজেন্টরা এসব কাজ সমন্বয় করছে বাধাহীনভাবে। শুধু বিদেশ পলাতক সন্ত্রাসীরাই নয় দেশের বন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও কারাগারে বসেই আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন।

চাঁদাবাজি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ক্যাবল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজধানী ঢাকায় বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আলী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে এ রকম তথ্য পেয়েছে পুলিশ। কাঁচাবাজার ও ডিশ ব্যবসায় চাঁদাবাজির টাকার ভাগ-বাটোয়ারার জেরেই ফরহাদকে হত্যা করা হয়েছে। আর এই হত্যাকাণ্ডের মূলে রয়েছে বিদেশে অবস্থানরত তিন সন্ত্রাসী রমজান, মেহেদী ও আশিক। তাদের মধ্যে মেহেদীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে বিদেশে অবস্থানরত পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের। তারা এ দেশে তাদের ‘বেতনভুক্ত’ কিলারদের দিয়ে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। পুলিশের তদন্তে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য ওঠে এসেছে।

গত ১৫ জুন দুপুরে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার আলীর মোড় এলাকার পূর্বাঞ্চল ১ নম্বর লেন সংলগ্ন বায়তুস সালাম জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করে বের হলে বাড্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রমজানের সঙ্গে পরামর্শ করে ভারতে অবস্থানরত সন্ত্রাসী আশিক ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত মেহেদী সেখান থেকেই ফরহাদ কিলিং মিশন সফল করতে যাবতীয় নির্দেশনা দেয়। নির্দেশ অনুযায়ী ফরহাদকে প্রকাশ্য দিবালোকে মসজিদের বাইরে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা করে জিসান-মেহেদী-আশিক গ্রুপের বেতনভুক্ত কিলাররা। ফরহাদ হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পেরেছে বিদেশে বসে এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীরা রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছেও চাঁদাবাজি করছে। ফরহাদ কিলিং মিশন সফল হওয়ার পর তারা আরো এক ব্যবসায়ীকে খুনের পরিকল্পনা করেছিল। তা সফল করার আগেই মেহেদীর কিলার বাহিনীর পাঁচ সদস্য ধরা পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের জালে।

গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিদেশে বসেই বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করছে। ফরহাদ হত্যার পর তারা আরেকজনকে হত্যার প্ল্যান করেছিল। এই গ্রুপটা বিদেশে বসেই তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা দেশের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি করতে চাচ্ছে। বিদেশে থাকায় তাদের গ্রেফতার করা কঠিন হলেও ওই নেটওয়ার্কে যারা দেশে রয়েছে আমরা তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তসংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান বর্তমানে দুবাইয়ে আছে। মেহেদী যুক্তরাষ্ট্রে আর আশিক ভারতে রয়েছেন। এছাড়া এই গ্রুপের আরো কয়েকজন ফ্রান্স ও সুইডেনে রয়েছে। আশিক আগে একটি রাজনৈতিক দলের ক্যাডার বাহিনীর শীর্ষ নেতা ছিল। তিনি বলেন, এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর হয়ে দেশের ভেতরে অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছে অনেকেই। তাদের মধ্যেই একজন অমিত যে আশিক-মেহেদী গ্রুপের কথিত কমান্ডার হিসেবে দেশে কাজ করত। অমিতের অধীনে বেশ কয়েকজন বেতনভুক্ত কিলার ছিল যাদের প্রতি মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হতো। অমিত সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। তার অবর্তমানে আশিক-মেহেদী গ্রুপ এখন এই বেতনভুক্ত গ্রুপটি নিয়ন্ত্রণ করছে। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী বিদেশে বসেই চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে ইন্ধন জোগাচ্ছে। এলাকার বখাটে, অর্ধশিক্ষিত ছেলেদের কাজে লাগিয়ে আধিপত্য বিস্তার করছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বাড্ডা ও আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন সিএনজি-লেগুনা স্ট্যান্ড, ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন স্থাপনা, ফুটপাত, বাজারসহ আরো কয়েকটি খাত থেকে চাঁদাবাজি করে জিসানসহ শীর্ষ এসব সন্ত্রাসীদের কর্মী বাহিনী। হুন্ডিতে তাদের কাছে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যাচ্ছে চাঁদাবাজির টাকা। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান গত কয়েক বছর ধরেই একরকম স্থায়ী আস্তানা গেড়েছে দুবাইয়ে। সেখানে দুইটি বড় রেস্টুরেন্ট রয়েছে তার। সেখানে বসেই সহযোগী জাফর, রনি, সেন্টু, স্বপন, মিরাজসহ অন্যদের দিয়ে ঢাকায় ত্রাসের রাজত্ব বজায় রেখেছে জিসান। মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দুই কর্মকর্তা হত্যা, আনসার সদস্য হত্যা, বাড্ডায় তোবা গ্রুপের এমডির শ্বশুড়সহ চাঞ্চল্যকর অনেক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল এই জিসান।

২০০১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা করে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মোট সাড়ে ১৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এরপর অপরাধজগতে নতুন মেরুকরণ হলেও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নতুন কোনো তালিকা হয়নি। ২০১০ সালের ১৫ মার্চ জাতীয় সংসদে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪২ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামের তালিকা উপস্থাপন করেন। তবে সে তালিকায় দুর্ধর্ষ অনেক সন্ত্রাসীর নাম ছিল না। ওদিকে আগের ২৩ জনের তালিকার ১২ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের বেশির ভাগই বিদেশে পালিয়ে থেকে দেশের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন।

গোয়েন্দাসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দেশে সৃষ্ট নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসীর নামে নতুনভাবে চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। এর মধ্যে আছেন আগের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম, হারিস, আরমান, জিসান, শাহাদাত, নবী হোসেন, নবীউল্লাহ নবী, হাবিবুর, পিচ্চি হেলাল, জব্বার মুন্না, ইমন, কামাল পাশা, শম্ভু, মিজান, নাইন শুটার রনি, কাওসার, আশিক, সেলিম, দিপু, আকতার প্রমুখ। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মিরপুরের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত পাঁচ বছর ধরে ভারতে বসেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। শাহাদাত দাবি করেছেন, তিনি এখন সন্ত্রাসী কর্মকা- ছেড়ে দিয়েছেন। ভালো হয়ে দেশে ফিরতে চান। তবে সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ফিরতে পারেননি। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে একবার সবুজ সংকেত মেলে। তখন দেশে ঘুরে গেছেন শাহাদাত। তবে এখন ভারতে তার অবস্থান কোথায় তা জানে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

২০১২ সালের ১৪ ফেব্রয়ারি কাশিমপুর-২ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পালিয়েছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ। গত বছরের ২৭ অক্টোবর কাশিমপুর-১ কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান তানভীরুজ্জামান ওরফে রনি নামের আরেক সন্ত্রাসী। এরপর তিনি গোপনে পালিয়ে যান ভারতে। এর আগে শীর্ষ সন্ত্রাসী মশিউর রহমান কচি জামিনে মুক্তি নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন। এভাবে একের পর এক শীর্ষ সন্ত্রাসী মুক্তি পেয়ে পালিয়ে গেলেও প্রশাসনের টনক নড়েনি।

এদিকে মোল্লা মাসুদ কলকাতায় গ্রেফতার হওয়ার আগেই নেপালের একটি কারাগারে সুড়ঙ্গ তৈরি করে পালানোর পর ভারতে গ্রেফতার হয় অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। তবে কালা জাহাঙ্গীর, সাবেক যুবদল নেতা আমিন রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর, ইমাম হোসেন, তানভীরুল ইসলাম জয়, আগা শামিম, বিকাশ, তার ভাই প্রকাশ, হারিস আহমেদ ও শাহাদাতসহ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী এখনো ভারত এবং এর পাশের দেশে লুকিয়ে রয়েছে। তবে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে সাতজন টিটন, পিচ্চি হেলাল, ফ্রিডম সোহেল, কামাল পাশা ওরফে পাশা, খোরশেদ আলম ওরফে রাশু, মশিউর রহমান কচি এবং আব্বাস ওরফে কিলার আব্বাস পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে থেকেই তাদের সারাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত শহীদ ২০১২ সালে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। এছাড়া বহু দিন থেকেই লাপাত্তা রয়েছে জব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ মানিক ও কামরুল হাসান হান্নান।

বিভিন্ন সূত্র জানায় ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, নেপাল এবং ফ্রান্সে আত্মগোপনে থাকা অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসীর মধ্যে প্রায় এক ডজন সন্ত্রাসী বিদেশে অবস্থান করেই বাংলাদেশে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সহযোগীদের দিয়ে চুক্তিভিত্তিক খুন এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ী এবং প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজি করে আসছে। আর এই টাকা বিদেশে পাচার করা হয়ে থাকে হুন্ডিসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থায়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আধিপত্য বিস্তার,আন্ডারওয়ার্ল্ড,চাঁদাবাজি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist