গাজী শাহনেওয়াজ
জমির ঊর্ধ্বসীমা জালিয়াতচক্র দমনে ডিসিদের চিঠি
সারাদেশে জমির ঊর্ধ্বসীমা জালিয়াতচক্র সক্রিয়। দিন দিন এর ক্ষেত্র বাড়ছে। বর্তমানে যা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ায় গুটিকয় কব্জায় দেশের লাখ লাখ একর কৃষি। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এসব প্রতারক দিব্যি অধরা। কৃষিজমির সুষম বণ্টন না হওয়ায় সমাজে বৈষম্য বাড়ছে বলে মনে করছে সরকার।
পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় বৈষম্য কমাতে ঊর্ধ্বসীমা গোপন করা জমির মালিক চক্রকে ধরতে সরকার এবার সোচ্চার হয়েছে। সারাদেশের জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে এসব প্রতারককে চিহ্নিত করে তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশ পালনে মাঠ প্রশাসন কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে অনেক জেলায় এসব অবৈধভাবে কৃষিজমি দখলে রাখা ব্যক্তিদের সন্ধান মিলেছে। এখতিয়ারবহির্ভূত সম্পত্তি দখলমুক্ত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রক্রিয়া কোনো কোনো জেলায় শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা আশা করছেন, উদ্ধার হওয়া লাখ লাখ একর জমি থেকে বছরে সরকারের কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব আয় হবে।
এর আগে ভূমি মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি জমির ঊর্ধ্বসীমা চক্রকে খুঁজে তালিকা করার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছিল। কমিটির সুপারিশ আমলে নিয়ে মন্ত্রণালয় ঊর্ধ্বসীমা চিহ্নিতের জন্য জেলা প্রশাসকদের পত্র দেয়। সংসদীয় কমিটি এবং মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ আমলে নিয়ে ডিসিরা তাদের কাজ করছেন।
কৃষি জমির ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করে প্রায় ৩ যুগের বেশি সময় ধরে অধরা আছেন মো. দারাজ আলী। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার শালবাহান ইউনিয়নের প্রামাণিকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা তিনি। তার পিতার নাম মৃত মো. দারোগ আলী। ব্যক্তি মালিকানায় ৬০ বিঘার বেশি কৃষিজমি রাখা অবৈধ। কিন্তু সরকারকে বোকা বানিয়ে এই দারাজ আলী নিজ নামে বাড়তি ২৩ বিঘা জমি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ভোগ-দখল করছেন। সরকারের কঠোর নীতির কাছে এতদিন পর এসে তার জালিয়াতির সব জারিজুরি ফাঁস হয়েছে। এখন অতিরিক্ত জমি সরকার খাসজমি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
লোহাকাচি গ্রামের মো. এবাজুল হকের সন্তান মো. হাসান আলীও সরকারকে অন্ধকারে রেখে ঊর্ধ্বসীমা জালিয়াতি করে সাধু সেজে বসে আছেন অনেক দিন ধরে। তার প্রতারণাও ধরা পড়েছে জেলা প্রশাসকের চিরুনি অভিযানে। তিনি সাড়ে ১০ বিঘা জমি অতিরিক্ত ভোগ-দখল করছেন। পেদিয়াগছ গ্রামের হাসিম মন্ডলের ছেলে মো. ইলিয়াস আলী মণ্ডল প্রায় ৫ বিঘা জমি নিজের দখলে রেখেছেন। ধরাগছ লোহাকাচি গ্রামের শরীয়তুল্লাহ্র ছেলে ইউসুছ আলী সরকারের দখলে সোয়া ১২ বিঘা জমি। আর পেদিয়াগছ গ্রামের আবুল মণ্ডলের দুই ছেলে ইসাহাস আলী মণ্ডল ও আবু বক্কর সিদ্দিকের দখলে রয়েছে ১২ বিঘা কৃষিজমি।
শুধু দারাজ আলী কিংবা ইসাহাস আলী নন; দেশের অসংখ্যা বিত্তশালী প্রতারক এভাবে অবৈধ পন্থায় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জমির ঊর্ধ্বসীমা লঙ্ঘন করে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিব্যি চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এসব প্রতারকের বিরুদ্ধে এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে তালিকা পাওয়ার পর ঊর্ধ্বসীমার অতিরিক্ত জমি সরকারের অনুকূলে ফেরত নেওয়া হবে। পরে তা খাসজমি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।
তবে, যেসব ভূমির মালিক ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করেছেন তারা চাইলে সরকারের কাছ থেকে খাসজমি লিজ নিয়ে নিজেরা ভোগ-দখল করতে পারবেন। এই প্রক্রিয়াতে খাসজমি লিজ দেওয়ার কারণে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।
জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ বলেন, জালিয়াতি কওে ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করে বাড়তি জমি রাখা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার। সারা দেশের তালিকা পাওয়ার পর বাড়তি জমি, ভূমির মালিকদের কাছ থেকে ফেরত আনা হবে। এসব জমি সরকারের অনুকূলে এনে খাসজমি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হবে। কোন অবস্থায় জমির ঊর্ধ্বসীমা লঙ্ঘনকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. রেজাউল করিম হীরা বলেন, ঊর্ধ্বসীমা গোপন করে বাড়তি জমি রাখা এক ধরনের প্রতারণা। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সংসদীয় কমিটিতে কিছু এলাকার ঊর্ধ্বসীমা ব্যক্তির তালিকা পেয়েছি। বাকি জেলার তালিকা এলে এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত তার সুপারিশ করা হবে।
জমির ঊর্ধ্বসীমার বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক দেওয়ান মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, কৃষিজমির সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা সমুন্নত রাখতে সময়ে সময়ে জমির ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ হয়েছে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু একজন ব্যক্তির অনুকূলে ৩০০ বিঘা রাখার বিধান জারি করেছিলেন। জনসংখ্যার হার বেড়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে তা কমিয়ে ১০০ বিঘা করা হয়। সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে এসে তৃতীয় দফা সংস্কার এনে ঊর্ধ্বসীমার পরিমাণ ঠিক করা হয় ৬০বিঘা। কারণ বিত্তশালীদের বিত্তবৈভবের ক্ষেত্র বাড়াতে কৃষিজমি কিনে একক মালিক হওয়াতে লাগাম টানতে ওই সীমা নির্ধারণ করা হয়, যা এখনো বহাল আছে। কিন্তু কিছু মানুষ ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করে বাড়তি অনেক জমি ভোগ-দখল করছেন। গাজীপর জেলাধীন কালিয়াকৈরসহ প্রায় ৪টি এলাকায় ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রমের সন্ধান মিলেছে বলে জানান প্রশাসন সার্ভিসের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, তালিকা চূড়ান্ত করে বাড়তি জমি খাস করা হবে। তবে, অকৃষি জমির ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধতা নেই।
আর সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মো. ইফতেখার হোসেন বলেন, জমির ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করা জমির মালিক চিহ্নিত করার বিষয়ে অবগত আছি। তবে, এ জেলাতে জমির ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রমের এখনো কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। কারণ হিসেবে মাঠ প্রশাসনের এই কর্মকর্তা বলেন, এই অঞ্চলের মানুষ অনেক চালাক। বিভিন্ন জনের নামে এসব এলাকার মানুষ জমি রাখেন। তবে, এই অঞ্চলে অবৈধ ভূমির মালিক বেশি, যোগ করেন এই জেলা প্রশাসক।
পিডিএসও/হেলাল