জুবায়ের চৌধুরী

  ০৯ জুন, ২০১৮

ঈদবাজারে জালনোট, লেনদেনে সাবধান!

* সক্রিয় অপরাধী চক্র মাঠে তৎপর পুলিশ * লেনদেনে সতর্ক থাকার পরামর্শ পুলিশের

ঈদবাজার সামনে রেখে আবারও তৎপরতা বেড়েছে দেশি-বিদেশি জালনোট প্রতারক চক্রের। জালনোট তৈরিতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গোপনে কারখানা গড়ে তুলেছে একাধিক চক্র। তবে ঈদবাজার জালটাকামুক্ত রাখতে বিশেষ নজরদারি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রতারকদের ধরতে ইতোমধ্যে অভিযানে নেমেছে তারা। তবে রোজা ও ঈদবাজারের লেনদেনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে নাগরিকদের পরামর্শ দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।

এদিকে, বৃহস্পতিবার রাজধানীর কদমতলীর বউবাজার এলাকার একটি বাড়ি থেকে জালনোট ছাপার সঙ্গে জড়িত চক্রের ১০ জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা। তাদের কাছ থেকে কোটি টাকার জালনোট জব্দ করা হয়েছে। ঈদবাজারে পাঁচ কোটি টাকার জালনোট ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিল প্রতারক চক্রটি। তার আগেই গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ল তারা। তাদের কাছ থেকে এক কোটি টাকার জালনোট, জালনোট তৈরির সরঞ্জাম, নিরাপত্তা সুতা, প্রিন্টার, ল্যাপটপ, কাগজ ও কালি জব্দ করা হয়েছে। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে জালনোট তৈরির কাজ করে আসছিল।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীর ও এর আশপাশের এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ৩৫-৪০টি চক্র জালনোটের কারবার চালিয়ে আসছে। এর মধ্যে মিরপুরের জাকির গ্রুপ, খিলগাঁও, সবুজবাগ ও বাসাবো এলাকায় লোকমান গ্রুপ, পুরান ঢাকায় ইমন গ্রুপ, মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকায় কাওসার গ্রুপ, জালটাকা তৈরির অন্যতম গুরু নুরুজ্জামান, সগীর আলী, মোস্তফা চিশতী এবং মাহবুবসহ ৪০টি চক্র জাল টাকার রমরমা ব্যবসা করে আসছে। এদের আবার শাখা-প্রশাখাও রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও আবার আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। জেল থেকে বেরিয়ে তারা আবারও জালনোটের কারবারিতে নেমে পড়ছে। এ কারণে জালনোট ও কারবারিদের দৌরাত্ম্য রোধ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এক লাখ টাকা তৈরি করতে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। আর বিক্রি হয় ছয় হাজার থেকে আট হাজার টাকায়। পরে বিভিন্ন হাত ঘুরে এ টাকা ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। একই আকারের ছোট মুদ্রার লেখা ধুয়ে বড় মুদ্রার ছাপ দিয়ে যেসব জালটাকা বানানো হয়, তার দাম বেশি এবং ধরাও কঠিন। ১০০ টাকার নোট সাদা করে ৫০০ বা ১০০০ টাকার জালনোট বানানো হয়। আর সাধারণ আর্ট পেপারে ছাপ দিয়েও জালনোট বানানো হয়। এ ছাড়া টাকা তৈরিতে মেশিনসহ ল্যাপটপ, প্রিন্টার, পেনড্রাইভ, নিরাপত্তা সুতা, টাকা বানানোর জন্য বিভিন্ন ডাইসও তৈরি করতে হয়।

জালটাকা চক্রের হোতারা দরিদ্র মানুষকে বাছাই করে মূলত নোট ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করে। এতে তাদের তিন ধরনের উপকার হয়। প্রথমত, সে ব্যক্তি ধরা পড়লেও মূল হোতাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে পারে না। দ্বিতীয়ত, আর্থিকভাবে দুর্বল হওয়ায় তারা বেইমানি করার সাহস করে না এবং তৃতীয়ত, তাদের অল্প টাকায় এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য পাওয়া যায়। খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে মূল কারবারিদের চুক্তি থাকে এক লাখ টাকার জালনোট ছড়িয়ে দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা পাবে। এরাই পরে রাজধানীসহ দেশের সব জেলার সর্বত্র বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, অভিজাত মার্কেট থেকে শুরু করে ফুটপাত পর্যন্ত সর্বত্র বেচাকেনার ভিড়ে বাজারে ছড়িয়ে দেয়। এ কাজে আবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীও জড়িত।

এক সময় এই সিন্ডিকেটে কোনো নারী সদস্য ছিল না। এখন অনেক নারী সদস্য এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। প্রতিটি স্তরেই এই সিন্ডিকেটের নারী সদস্য রয়েছে। কখনো গৃহিণী, কখনো কলেজছাত্রী সেজে জাল টাকা বহন করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে তারা। আবার এদের মাধ্যমেই পণ্য কেনাকাটা করে মার্কেটে জাল টাকার বিস্তার ঘটাচ্ছে প্রতারক চক্র। এ জন্য তাদের দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের কমিশন। ধরা পড়লে ও তাদের আইনি সহায়তাও দেয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচরসহ রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রতারকরা জালটাকার নোট তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছে। এসব এলাকা থেকেই জালটাকা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বণ্টন করা হয়। এই চক্রের একজন গডফাদার আছে। ছদ্মনামধারী এই গডফাদারের নামে পুরো ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। এ কারণে তাদের অবস্থান বা পরিচয় নিশ্চিত হতে বেশ বেগ পেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। বর্তমানে রাজধানীতে এই টাকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে ইব্রাহিম নামের একজন। তবে এটি তার আসল না নকল নাম সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় পুলিশ। এ ছাড়া জালটাকা তৈরির মূল হোতা জাকির মাস্টার ও কাওছার মিয়া দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিয়ে আছে। এরা আত্মগোপনে থাকলেও সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় রয়েছে। কল্যাণপুরের নার্গিস আক্তার, শারমিন আক্তার, সোহেল, সাগর, রোজিনাসহ শতাধিক পুরুষ ও নারী এ টাকা তৈরি এবং বণ্টনে সার্বক্ষণিক কাজ করছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে।

ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, দেশি-বিদেশি একাধিক চক্র দীর্ঘদিন ধরে জাল টাকার ব্যবসা চালিয়ে আসছে। মূলত ঈদ বাজারকে সামনে রেখে চক্রটি ব্যবসায় নামে। বছরের অন্য সময় চক্রের সদস্যদের তৎপরতা তেমন দেখা না গেলেও এই সময় তারা আরো সক্রিয় হয়ে উঠে। এ কারণে অতীতে যারা এ ধরনের অপরাধে জড়িত ছিল, তাদের ইতোমধ্যেই নজরদারিতে রাখা হয়েছে। গতিবিধি লক্ষ করা হচ্ছে। তেমন কিছু পেলে সঙ্গে সঙ্গেই অভিযান পরিচালনা করা হবে।

গত মাসে ডিএমপি সদর দফতরে পবিত্র রমজান ও ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর সার্বিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত সভায় ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, রমজান ও ঈদের সার্বিক নিরাপত্তায় সাদা পোশাকে ও ইউনিফর্মে বিশেষ টিম থাকবে। জালটাকা রোধে বিভিন্ন মার্কেট, শপিং মলে পুলিশ নিরাপত্তা দেবে। পাশাপাশি মার্কেটের নিরাপত্তার জন্য মার্কেট মালিক সমিতিকে সিসিটিভি, আর্চওয়ে, কন্ট্রোল মেশিনসহ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাস টার্মিনাল থেকে রাতের বেলায় বাসের যাত্রীদের অবশ্যই ভিডিও করে রেখে বাস টার্মিনাল থেকে বের করতে হবে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জালটাকা ব্যবসায়ী চক্রের প্রত্যেকেই পেশাদার। তারা একদিকে জালটাকার নোট তৈরি করে, অন্যদিকে জালটাকার ব্যবসাও করে। এসব চক্রের অনেক সদস্যই এ ব্যবসার সঙ্গে অনেক বছর ধরে জড়িত। তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে জালটাকা তৈরি করে। ধরা পড়ার ভয়ে তারা এক বাসায় বেশি দিন থাকে না। কয়েক মাস পরপর তারা বাসা বদলে চলে যায়, এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়। সেখানেই গড়ে তোলে জাল টাকা তৈরির কারখানা।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, রমজান ও ঈদের বাজারে জালনোট ঠেকাতে র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই র‌্যাবের সব ব্যাটালিয়নকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন শপিং মল ও বাজারে জালনোট শনাক্ত করার জন্য ডিএমপির মেশিন রয়েছে। সন্দেহ হলেই লেনদেনের আগে ক্রেতা-বিক্রেতা সেখানে টাকা যাচাই করতে পারবেন।

একই বিষয়ে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, জালটাকা তৈরির সম্ভাব্য স্থানগুলোতে অনেক আগেই নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। খোঁজখবরও নেওয়া হচ্ছে। এই চক্রকে ধরতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। ইতোমধ্যে এসব চক্রের অনেক সদস্যকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কোথাও জালটাকা তৈরি হচ্ছে কি না জানা থাকলে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে গোপনে জানাতে নগরবাসীকে অনুরোধ করেছেন তিনি। এ ছাড়াও জালটাকা সংক্রান্ত প্রতিটি মামলাই পুলিশ গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঈদবাজার,জালনোট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist