জুবায়ের চৌধুরী

  ০১ জুন, ২০১৮

গৃহকর্মীর ‘আত্মহত্যা’

জীবন যেখানে মূল্যহীন!

*২৮৬ গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার শিকার *১৮ বছরে শুধু আদুরী নির্যাতনের ঘটনায় সাজা *২০০১-২০১০ সালে নির্যাতন-অপমৃত্যু ৭৯৮

অভাব-অনটনের তাড়নায় অন্যের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে ঠাঁই হয় অনেক নারী ও শিশুর। সংসারের অভাব পূরণে দিনরাত খাটলেও ঠিকমতো খেতে-পরতে পায় না তারা। সঙ্গে রয়েছে নির্যাতনের শিকার হওয়ার নির্মম অভিজ্ঞতা। মুখ বুঝে এসব নির্যাতন-অত্যাচার সহ্য করার কারণে অনেক ঘটনাই থেকে যায় ঘরের চার দেয়ালের ভেতরেই। আবার কেউ কেউ এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে আইনের আশ্রয় নিলেও প্রভাবশালীদের কাছে হার মানতে হয়। অর্থের কাছে ঠুনকো হয়ে পড়ে গৃহকর্মীদের অশ্রুজল। নির্মম নির্যাতন করেও পার পেয়ে যান গৃহকর্তা-কর্ত্রীরা। কেউ কেউ আইনের আশ্রয় নিলেও নির্যাতনকারী গৃহকর্তা-কর্ত্রীরা অপরাধের সাজা থেকে বাঁচতে অনেক সময় টাকা দিয়ে আপসরফা করে নেন। প্রভাবশালীদের চাপে টিকতে না পেরে আদালতে গিয়ে অভিযোগ তুলে ফেলতে বাধ্য হন হতদরিদ্র গৃহকর্মী বা তাদের পরিবারের সদস্যরা। এভাবেই চলছে দিনের পর দিন। গৃহকর্মীদের জীবন যেন মূল্যহীন।

২০০৬ সালে নতুন শ্রম আইন পাস হয়েছে। কিন্তু এখানেও উপেক্ষিত থেকেছে গৃহকর্মীরা। তাদের গৃহশ্রমিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছেন এমন প্রায় ২৩টি সংগঠন মিলে গড়ে তুলেন গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক (ডিডব্লিউআরএন)। তারা প্রায় গৃহশ্রমিকদের আইনের আওতায় আনার দাবি তুলে আসছেন। কিন্তু তাদের সে দাবি আজও সরকারের কানে পৌঁছায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ গৃহকর্মীই তার মালিকের কাছে চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। অমানবিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে তারা আত্মহত্যা করছেন। অনেক গৃহকর্মী আবার হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। হত্যাকাণ্ডের আলামত থাকার পরও গৃহকর্মীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গৃহকর্মীদের বেলায় টাকা আর পেশিশক্তির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ন্যায়বিচার।

২০১৫ সালে গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপিকে (১১) মারাত্মকভাবে নির্যাতনের অভিযোগে ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজীব ও তার স্ত্রী জেসমিন জাহানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আদালত মাহফুজা নির্যাতনের মামলায় ক্রিকেটার রাজীব ও জেসমিন জাহানকে বেকসুর খালাস দেন। এ দম্পতির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে আদালতের পর্যবেক্ষণে জানানো হয়।

তবে এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম আছে। সেটি হচ্ছে আদুরী। শুধু শিশু গৃহকর্মী আদুরী নির্যাতনের ঘটনায় বিচার হয়েছে। আর কোনো মামলায় চূড়ান্ত বিচারের কোনো নজির নেই। কিন্তু ক্রিকেটার শাহাদাত ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগে আদালত থেকে তারা বেকসুর খালাস পেয়েছে। সেটি তাদের মধ্যে মিলমিশ হয়ে গিয়েছিল বলে। ভুক্তভোগী তার স্টেটমেন্ট পরিবর্তন করে ফেলেছে। নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মী যে স্টেটম্যান্ট দিয়ে অভিযোগ করেন, এরপর আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের সময় তার এই স্টেটমেন্টটি পরিবর্তন হয়ে সম্পূর্ণ উল্টে যায়। এ কারণেই অনেক মামলার বিচার হয় না। কারণ আসামিপক্ষ ও বাদীপক্ষের মধ্যে মিলমিশ হয়ে যায়। সেই ভিত্তিতে আদালত আসামিকে খালাস দিয়ে দেন। অথচ এই জায়গায় আইনের একটি কঠোরতা থাকা প্রয়োজন। নয়তো গৃহকর্মী নির্যাতনের কোনো বিচার সম্ভব নয়।

দেখা যাচ্ছে, গৃহকর্মী হত্যা মামলার ক্ষেত্রে পুলিশের করা প্রতিবেদনে শরীরে আঘাতের চিহ্ন ও হত্যার ধরন উল্লেখ থাকে। কিন্তু মেডিকেল রিপোর্টে প্রায়ই তা হয়ে যায় আত্মহত্যা। এক্ষেত্রে হাসপাতালের প্রতিবেদন যাচাই করেও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন, শুধু আইন দিয়ে নয়, সমাজের সব পর্যায়ে জনসচেতনতা ও মানসিকতার পরিবর্তন না হলে গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়।

গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের (ডিডব্লিউআরএন) দেওয়া তথ্য মতে, দেশে প্রায় ২৫ লাখ গৃহকর্মী রয়েছেন। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার ও অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ৭৯৮ জন গৃহকর্মী। এর মধ্যে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০০। চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে ২৯৯ জনকে। এই ১০ বছরে ৭৯৮ জন গৃহকর্মী শারীরিক নির্যাতন, হত্যা, যৌন নির্যাতন ও আত্মহত্যার শিকার হয়েছেন। অপরদিকে ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পাঁচ বছরে ৩২৫ জন গৃহকর্মী শারীরিক নির্যাতন, হত্যা, যৌন নির্যাতন ও আত্মহত্যার শিকার হয়েছেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে বিভিন্নভাবে ২৮৬ জন গৃহকর্মী নির্যাতন ও অপমৃত্যুর শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৮৩ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ২৮৬টি ঘটনার মধ্যে থানায় মামলা হয়েছে মাত্র ১২২টির। শারীরিক নির্যাতনে ৩২ জন এবং অজ্ঞাত কারণে ১১৭ জনসহ ১৪৯ জন গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে।

এছাড়া গত ৫ বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে ৬৪ জন গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০১৩ সালে ৬১ জন, ২০১৪ সালে ৪৪ জন, ২০১৫ সালে ৬৩ জন ও ২০১৭ সালে ৪৩ জন গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার শিকার হন। আর চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ১১ জন গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার শিকার হন, যাদের মধ্যে ৮ জনই শিশু। গত পাঁচ বছরে ২৮৬ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হলেও বিচার হয়েছে মাত্র একটি ঘটনার। শুধু গৃহকর্মী আদুরীকে নির্যাতনের ঘটনায় সাজা শুনিয়েছে আদালত।

পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর ১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী আদুরীকে নির্যাতন করে পল্লবীর ডিওএইচএস এলাকার একটি ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান ও তার মা ইসরাত জাহানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ঘটনার চার বছর পর গত বছরের ১৮ জুলাই নওরীন জাহানকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত। নওরীন কারাগারে রয়েছেন। দেশব্যাপী আলোচিত এই ঘটনায় গৃহকর্ত্রীর বিচার হয়েছে। এছাড়া আর কোনো ঘটনার বিচার এখন পর্যন্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যার ঘটনার চেয়ে মামলা কম হওয়া, বিচার কম হওয়া হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য। এ রকমটা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে গৃহকর্মী নির্যাতন বাড়বে। ভুক্তভোগীরাও আইনের আশ্রয় নেবে না। দুর্বৃত্তরা ঘটনা ঘটিয়েছে পার পেয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা এমন একটিও উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারছি না যে উদাহরণ মানুষের পশুশক্তিকে পরাজিত করবে। তবে এসব কমিয়ে আনতে ও প্রতিহত করতে সমাজের সব স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করছেন তিনি।

সম্প্রতি শ্যামপুরে লাবনী (১২) নামে এক গৃহকর্মীর গায়ে গরম পানি ঢেলে নির্যাতন করা হয়। পরে এ ঘটনায় অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রী মারিয়া সুলতানাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। লাবনীর ভাষ্য, ভাত একটু বেশি সিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তার গায়ে গরম পানি ঢেলে দেয়া হয়। ২২ জানুয়ারি চকবাজারে রুনা আক্তার (১৪) নামের এক গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে গৃহকর্তা ড. সায়েম। পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সন্তানের প্রস্রাব পরিষ্কার না করায় গৃহকর্ত্রী ডা. নীনাও তাকে মারধর করত। এরূপ তুচ্ছ ঘটনায় গৃহকর্মী নির্যাতন যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অহরহ ঘটনা ঘটলেও মামলা কিংবা বিচারের ঘটনা খুবই কম।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদা বলেন, এ ধরনের মামলা তদন্ত চলাকালীন উভয় পক্ষের আপস হয়ে যাওয়ায় ভুক্তভোগীরা বিচার পাচ্ছে না। তাছাড়া, আদালতে চার্জশিট দেওয়ার আগে কোনো মামলা আপসযোগ্য তা আইনে উল্লেখ রয়েছে। তাই পুলিশেরও কিছু করার থাকে না। তিনি বলেন, যারা গৃহকর্মী নির্যাতন করে তারা করবেই! তবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যারা এসব করছে তাদের যাতে বোধটা জাগ্রত হয়—সেই লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গৃহকর্মীর আত্মহত্যা,জীবন,গৃহকর্মী নির্যাতন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist