নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৬ এপ্রিল, ২০১৮

ডাকাত দলের সদস্য

বয়সে কচি, নিষ্ঠুরতায় জল্লাদ!

বাসচালকের সহকারীকে সেদিন ২০ বছর বয়সী এক তরুণ বলেছিলেন, ‘ভাই, আমরা বিপদে পড়েছি। আমাদের একটু নিয়ে যান।’ কিন্তু যাত্রীর কাঁধে ব্যাগ দেখে সহকারীর সন্দেহ হয়। তাই তিনি বাসে তুলতে চাননি। কিন্তু চালক বললেন নিতে। ওই তরুণের সঙ্গে সঙ্গে আরো ১০ থেকে ১২ জন বাসে ওঠেন। সবার বয়স হবে ১৮ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। তারা একটি ডাকাতির গ্যাং পার্টির সদস্য। তাদের দলে আছে ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য। তারা বয়সে কচি, নিষ্ঠুরতায় জল্লাদ।

‘বিপদাপন্ন’ ওই তরুণদের নৃশংস চেহারা বাস ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে আসে। ব্যাগ থেকে বের হয়ে সবার হাতে উঠে আসে চাপাতি। চালককে বাস থামাতে বলেন। এরপর চালককে ছুরিকাঘাতে আহত করে বাসের ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেন একজন। পরে মারা যান চালক। সহকারী আর সুপারভাইজারের হাত-পা বেঁধে ফেলেন তারা। বাসে থাকা ১৬ জন যাত্রীর হাত-পাও বেঁধে ফেলা হয়। লুট করা হয় তাদের জিনিসপত্র।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি আশুলিয়া এলাকায় বাসচালক শাজাহানকে (৪০) খুন করে ১৬ জন যাত্রীর সব মালামাল লুট করেন অজ্ঞাত ডাকাত দলের সদস্যরা। এ ঘটনায় নিহত চালকের ভাই মজিবর আশুলিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। এরপর ডাকাতি ও খুনের মামলায় সম্প্রতি তরুণ ডাকাত দলের ১৯ সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের দলনেতাসহ ১৬ জন ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। পুলিশ বলছে, তাদের কাছ থেকেই শুনেছে বাসসহ বিভিন্ন স্থানে ডাকাতির সময় নৃশংসতার ঘটনাগুলো। গ্রেফতার ১৬ জনের সবাই এখন কারাগারে।

গ্রেফতার ডাকাত দলের সদস্যরা হলেন আশুলিয়ার ইমরান হোসাইন (২২), নাটোরের জামিরুল ইসলাম (২০), টাঙ্গাইলের ইমরান হোসেন (১৯), উজ্জ্বল হাসান (১৯), কুড়িগ্রামের বাদশা (১৯), ময়মনসিংহের নাঈম মিয়া (১৮), আশুলিয়ার জিহাদ (১৮), সিরাজগঞ্জের আরিফুল ইসলাম (১৯), কালিয়াকৈরের লিটন (১৮), চাঁদপুরের সজীব হোসেন (২২), আশুলিয়ার আল আমিন (২৩), জয়দেবপুরের রিপন হোসেন (১৮), রাজশাহীর মাকসুদুর রহমান (১৮), আশুলিয়ার রাকিবুল হাসান (১৮), কুড়িগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন (২৩) ও আরিয়ান আশিক (২২)।

পুলিশ বলছে, তাদের বিরুদ্ধে একাধিক ডাকাতির মামলার খোঁজ মিলেছে। ২ বছর ধরে ডাকাত দলটি সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও পাবনায় অন্তত ২৮টি ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন থানার ভিন্ন ভিন্ন মামলায় তারা আসামি।

আশুলিয়া থানার মামলায় সন্দেহভাজন আরিয়ান আশিককে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে গত ২৯ মার্চ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেন তিনি। সেখানে আশিক বলেছেন, তাদের দলের আলামিন বাসচালককে গাড়ি থামাতে নির্দেশ দেন। কিন্তু চালক সে কথা না শুনে বাস চালাতেই থাকেন। তখন রুবেল আর ইমরান চাকু দিয়ে চালকের বুকে আঘাত করেন। আলামিন স্টিয়ারিংয়ে বসে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেন। চালকের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। লিটন, সে ও সজীব চালকের হাত-পা বেঁধে ফেলেন। সেই অবস্থায় তাকে টেনে নিয়ে বাসের পেছনে ফেলে রাখা হয়। এরপর যাত্রীদের কাছে থাকা মোবাইল, ল্যাপটপ, মানিব্যাগসহ সব মালামাল কেড়ে নেন তারা।

বাসের সুপারভাইজার শহিদুল খান বলেন, দেড় ঘণ্টার মতো ডাকাতদের নিয়ন্ত্রণে ছিল বাস। মির্জাপুর থেকে বাস চালিয়ে ঢাকার নবীনগরে এসে বাস রেখে পালিয়ে যায় ডাকাতরা।

তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি (ঢাকা জেলা) পরিদর্শক এ এফ এম সায়েদ মুন্সী বলেন, এই দলের বিরুদ্ধে বাসে একটি মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগও তাদের কাছে আছে। একটি ডাকাতির ঘটনার পর বাসের যাত্রীরা এই অভিযোগ করেন। পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার সময়ও ডাকাত দলের সদস্যরা এটি স্বীকার করেন। কিন্তু মেয়েটি বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।

তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি (উত্তর, ঢাকা) মোহাম্মদ তানভীর মোর্শেদ বলেন, ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবারকে তারা খুঁজছেন। খুঁজে পেলে তাদের বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষী পাওয়া যাবে।

পুলিশ ও তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, এই ডাকাত দলের সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জনের মধ্যে থাকে। দলটির প্রধান পাঁচজন হলেন রিয়াজ, রুবেল, আশিক, আলামিন ও ইমরান।

গত ১ জানুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকার রয়েল সেতুর কাছে লেগুনার যাত্রী ১৬ বছর বয়সী শফিককে ছুরিকাঘাত করেন অজ্ঞাত ডাকাত দলের সদস্যরা। সেসহ আরো কয়েকজন যাত্রীর মোবাইল ফোনসহ মালামাল কেড়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় কালিয়াকৈর থানার হত্যা মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আবদুল মান্নান মিঞা, যিনি আশুলিয়ার ব্যাংক ডাকাতি ও খুনের মামলায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কালিয়াকৈর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল হাকিম বলেন, আশুলিয়ায় যারা ডাকাতির সময় বাসচালককে খুন করেছে, ওই একই গ্রুপ কালিয়াকৈরেও লেগুনা যাত্রী খুনে জড়িত।

আশুলিয়ার বাসচালক শাহজাহান হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ তানভীর মোর্শেদ বলেন, এই মামলায় গ্রেফতার প্রত্যেক ডাকাত দলের সদস্যের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকার খোঁজ মিলেছে। পাবনার ঈশ্বরদী, টঙ্গী ও ময়মনসিংহের ভালুকায় আছে ডাকাতির পর খুনের মামলা। টাঙ্গাইল ও আশুলিয়ায় থানায় একাধিক ডাকাতির মামলা আছে।

তদন্ত কর্মকর্তা তানভীর মোর্শেদ বললেন, আশুলিয়া, গাজীপুর, মির্জাপুর ও টাঙ্গাইলে থাকেন তারা। অনেকে গার্মেন্টে চাকরি করেন, কেউ দোকানদারি করেন। তাদের দলের অন্যতম বড় ইমরান এখন অন্য মামলা জেলে আছেন।

ধলেশ্বরী পরিবহনের চালক নিহত শাহজাহানের ছোট্ট দুটি মেয়ে। মায়ের সঙ্গে থাকে টাঙ্গাইলে চরজানা গ্রামে। নিহত চালকের ভাই বাদী মজিবর বললেন, বড় কষ্টে আছে ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা। জমি নেই। বাস চালিয়ে যা পেতেন, তা দিয়ে সংসার চালাতেন।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ডাকাত,নিষ্ঠুরতা,ডাকাতি,মামলা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist