জুবায়ের চৌধুরী

  ০৬ এপ্রিল, ২০১৮

অনলাইনে জঙ্গিবাদ ঠেকানোর সক্ষমতা তলানিতে!

দীর্ঘদিন ধরেই সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ব্লগে ব্যাপকভাবে সক্রিয় জঙ্গিরা। এই উগ্রপন্থিরা নামে-বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে নানা উগ্র মতবাদসহ উসকানিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছেন। সরাসরি হত্যার হুমকিও দিচ্ছেন ভিন্নমতের লোকজনদের। আবার হুমকি দেওয়ার পর কয়েকজন মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীকে হত্যার নজিরও আছে। উগ্রপন্থিদের গ্রেফতারের দাবিতে বিভিন্ন সময় অনলাইনে ঝড় উঠলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলেমি ছিল চোখে পড়ার মতো। যদিও ঘটনা ঘটার পর তাদের তৎপরতা দেখা যায়। কয়েকদিন পর আবার সেই গাছাড়াভাব। আবার উল্টো ঘটনাও আছে। নির্দিষ্ট মহলের প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে কেউ ফেসবুক-ব্লগে কটূক্তি করার সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতারেরও নজির আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ ধরনের দ্বিমুখী আচরণ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পুলিশ-গোয়েন্দারা চাইলেই উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা গাফিলতি করে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ওপর অদৃশ্য চাপও কাজ করে। তবে গোয়েন্দারা বলছে, মূলত প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও বিশেষজ্ঞ জনবলের অভাবে অপপ্রচার চালানোর সঙ্গে সঙ্গেই উগ্রপন্থি কাউকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এত এত সাইট আছে, এর কোনটা থেকে কখন কে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করছে, তা নজরদারি করাও সম্ভব হচ্ছে না। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন সাইবার অপরাধ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঢাকায় সাইবার অপরাধে জড়িত যেকোনো ব্যক্তিকে চাইলেই শনাক্ত করা সম্ভব।

উগ্রপন্থিদের দাপটে কোণঠাসা মুক্তবুদ্ধির চর্চা : দেশে উগ্রপন্থি মানসিকতার বিস্তার বেড়েই চলেছে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদী মতাদর্শ প্রসারে প্রধান হাতিয়ার এখন সোশ্যাল মিডিয়া। অনলাইনে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় উগ্রপন্থিরা। নামে-বেনামে লাখো আইডি দিয়ে তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীদের বিরুদ্ধে লিখে যাচ্ছে, তীর্যক মন্তব্য করছে বিভিন্ন পোস্টে। ‘ডিজিটাল’ এই উগ্রবাদীদের দাপটে অনেকটা কোণঠাসা ও ভীত মুক্তবুদ্ধির চর্চার পক্ষের লোকেরা।

সম্প্রতি দেশের প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার মানুষ যখন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তখন উগ্রপন্থিরা তার ওপর জঙ্গি আক্রমণকে ‘ফরজ’ বলে তা ‘জায়েজের’ চেষ্টাও চালাচ্ছে! কী ভয়ংকর তাদের মনোবাসনা। সোশ্যাল মিডিয়ার এসব মন্তব্যে তাদের বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ ঘটছে ভয়াবহ মাত্রায়। এর আগেও দেশের নানা প্রান্তে ব্লগার- লেখকদের ওপর জঙ্গি হামলার পর এ গোষ্ঠীটিকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

গত ৩ মার্চ সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বদ্যিালয়ে (শাবিপ্রবি) নিজ ক্যাম্পাসের একটি অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর থেকে এমন হাজারো মৌলবাদী পোস্ট আর কমেন্টে ভরে গেছে ফেসবুক-টুইটারসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া। ঘটনার দিন জাফর ইকবালকে নিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত নিউজের কমেন্ট বক্সে জে এইচ এম ইয়াসিন খান নামের একজন লিখেছেন, ‘জাবর ষাঁড় মরে নাই? মরলে ভালোই হইতো।’ একই সংবাদের কমেন্ট বক্সে ‘খলিল’ পরিচয়ে একজন লিখেছেন, ‘একটা নাস্তিকের ওপর হামলা চালানো হয়েছে, ওর পক্ষে কোনো মুসলমান কথা বলতে পারে না।’ অন্য একটি দৈনিক পত্রিকার নিউজের কমেন্ট বক্সে মোহাম্মদ মারুফ নামে একজন লিখেছেন, ‘হামলাকারীকে গালাগালি করতে ইচ্ছে করতেছে। তুই ভোঁতা ছুরি নিয়ে গেলি কেন? একটি ধারালো ছুরি নিয়ে যেতে পারলি না...?’

এর আগে ফেসবুকে যেসব উগ্রপন্থি বিভিন্ন সময় অন্যদের হত্যার হুমকি দিয়েছে, তাদের অন্যতম শাফিউর রহমান ফারাবী। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজীব হায়দার উগ্রপন্থিদের হামলায় নিহত হওয়ার পর ফরাবী হুমকি দিয়েছিলেন, যে ইমাম রাজীবের জানাজা পড়াবেন তাকেও হত্যা করা হবে। এরপর ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন ফারাবী। একই বছরের ২১ আগস্ট তিনি জামিন পান। ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ফারাবী তার ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকায় থাকে। তাই তাকে এখানে (বাংলাদেশে) হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে।’ এরপর ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর দুর্বৃত্তদের হামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় খুন হন মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়। হামলায় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন।

সাইবার জগতে অনেক ব্লগারকে নিয়েই উগ্রপন্থিরা উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে। তারা মুক্তমনা অনেক ব্লগারের বক্তব্যের ভুল ও অপব্যাখ্যা প্রচার করছে। তবে এসবের কোনো কিছুতেই নেই নজরদারি। গোয়েন্দাদের আগাম তথ্যের ভিত্তিতে আইনের আওতায় আনা যায়নি কোনো সাইবার অপরাধীকেই। পুলিশ ও র‌্যাবের গোয়েন্দারা দাবি করছেন, ২০১৩ সালে ব্লগ ও সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচারের বিষয়টি নজরে আসে সরকারের। এরপর নজরদারির ব্যাপারে জোর দেওয়া হলেও গত পাঁচ বছরে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে শতাধিক ব্লগ ও ফেসবুকের পেজকে সন্দেহজনক বলে শনাক্ত করেছে গোয়েন্দারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) সাইবার ক্রাইম ইউনিট থাকলেও তারা সব ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। র‌্যাবের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তের মধ্যেই। অভিজিৎ রায় হত্যার তদন্তে নেমেও সীমাবদ্ধতায় ভুগছে ডিবি পুলিশ।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আমরা বেশ কিছু ব্লগ, ফেসবুকের পেজে নজরদারি করছি। জুমার খুতবা, কিত্তাল টিউব, বাঁশের কেল্লা, আনসারুল্লাহ বাংলাসহ যেসব পেজে উসকানিমূলক বক্তব্য পাওয়া গেছে, সেগুলো বন্ধ করা হয়েছে। তবে এরপরও ভিন্ন নামে পেজ খুলে তৎপরতা চালানো হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সাইবার ক্রাইম নামে একটি বিভাগ আছে, তবে তেমন প্রযুক্তি নেই। সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা এগোতে পারি না।

এদিকে, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম দমন ছাড়াও অন্যান্য অপরাধ দমনে সাইবার জগতে নজরদারি বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও জঙ্গি দমনে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম বন্ধে ফিজিক্যাল পেট্রোলিংয়ের চেয়ে সাইবার জগতে পেট্রোলিংয়ে জোর দিতে হবে। এর মাধ্যমে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ জন্য সাইবার অপরাধ দমনে লোকবল বাড়ানোর পাশাপাশি টেকনিক্যাল সাপোর্ট বাড়ানো জরুরি বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই সন্ত্রাসীরা এখন অনলাইনে কাজ করছে। তাদের প্রত্যেকটি গ্রুপের আবার নিজস্ব অর্থায়নে পৃথক ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন বা অ্যাপস আছে। এতেই বোঝা যায় প্রযুক্তিগতভাবে তারা কতটা সুসংগঠিত। আর এদের যদি মনিটরিং করতে হয় তাহলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশের ভেতরে যে গেটওয়েগুলো আছে, সেই গেটওয়েগুলোতে আমাদের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার দুটোই ব্যবহার করতে হবে। এ দুটো জিনিস ব্যবহার করার মাধ্যমে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের কার্যক্রমের ডিজিটাল কর্মকাণ্ড নজরদারি করা যাবে। তাদের অর্থায়নের উৎসটা কী সেটাও জানা যাবে। কিন্তু আমাদের যেসব ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স আছে সেগুলো গেটওয়েগুলোতে নেই। ফলে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম সঠিকভাবে ধরা যাচ্ছে না। গেটওয়ের ভেতরেই আমাদের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার বসিয়ে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত করে নজরদারি করলে বিষয়টি অনেক বেশি কার্যকর হবে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ইসলামের আলো, সালাউদ্দিনের ঘোড়া, দৃষ্টিভঙ্গি, যদি রাত পোহালে শোনা যেত শেখ হাসিনা মরে গেছে, দ্য মেসেজ অব ইসলাম, ইসলাম-ই-রাজনীতি, শিবির সংবাদ, জিহাদের ঝান্ডা আমরা চিরদিন উঁচু রাখব, বাগদাদ থেকে বাংলা, জিহাদ আর জিহাদ, তিতুমীর-১, তিতুমীর-২, বাঁশের কেল্লা, বাঁশের কেল্লা-নিউ, টিনের চালে কাক আমি তো অবাক, জঙ্গিদের সঙ্গে কথোপকথন, সত্যের পথের সৈনিক, দাওলা আলী ইলাহা, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহরীর, কওমি জিহাদি বাংলাদেশ, নাঙ্গা তরবারি, জেরুজালেমের পথে, আফতাব কিং ও কিতালটিউব—এ ধরনের অনেক উসকানিমূলক ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে প্রকাশ্যে জঙ্গিবাদের বক্তব্য প্রচার করে যাচ্ছে। তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো উগ্রবাদীদের নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিবিরোধী ১৬টি বড় অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এসব অভিযানে ৫৯ জন শীর্ষ জঙ্গি মারা যায়। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকসহ গুলি ও অস্ত্র। গ্রেফতার করা হয় আরো অনেককে। তারা বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় কারাগারে বন্দি রয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জঙ্গিবাদ,সন্ত্রাস,অপরাধ,সাইবার জগত
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist