জুবায়ের চৌধুরী

  ০২ এপ্রিল, ২০১৮

রাতের মাইক্রোবাস থেকে সাবধান!

মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, উত্তরায় ছোট আকারে পোশাক রফতানির ব্যবসা শুরু করেছেন তিন বছর ধরে। কাজের জন্য প্রায়ই তাকে পুরান ঢাকায় আসতে হয়। রাত করে উত্তরার বাসায় ফেরেন। ঘটনাটি গত ২৭ জানুয়ারির। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার আশায় রাত ৯টায় ফার্মগেট থেকে একটি প্রাইভেট মাইক্রোবাসে চড়ে বসেন। ওই গাড়িতে তার সঙ্গী ছিলেন আরো তিনজন। মাইক্রোবাসটি মহাখালী পার হলে তার পাশে বসা লোকটি তার কাঁধে হাত রাখেন। বলেন, ‘যা কিছু আছে সব বের করুন। চিৎকার-চেঁচামেচি করে কোনো লাভ নেই।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে বসা লোকটি সালাউদ্দিনকে বড় একটি ছুরি দেখান।

ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন তার সঙ্গে থাকা ব্যাগ, মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনতাইকারীদের হাতে তুলে দেন। এরপর ব্যবসায়ীর চোখ বেঁধে ফেলে ছিনতাকারীরা। এ সময় তিনি ছিনতাইকারীদের কাছে প্রাণভিক্ষা চান। ছিনতাইকারীরা তাকে মারা না মারা নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। তিন নম্বর ছিনতাইকারী ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন মাইক্রোবাস থেকে ফেলে দিতে নির্দেশ দেন। সঙ্গে এ-ও বলে দেয়, এ ঘটনা যেন কোনোভাবেই থানা পুলিশকে না জানানো হয়। একপর্যায়ে ওই ব্যবসায়ীকে উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ভেতরে একটি নির্জন খালি প্লটের পাশে ফেলে যায় ছিনতাইকারীরা। সালাউদ্দিনের মানিব্যাগে দেড় হাজার ও ব্যাগে ৩৭ হাজার টাকা ছিল। এ ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজও নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। পরে অবশ্য এ ঘটনায় কোনো মামলা কিংবা জিডি করেননি ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন।

সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরের আরেক ব্যবসায়ী পঙ্কজ কুমার পাল একই ঘটনার শিকার হন। তিনি গুলিস্তান থেকে মালামাল কিনে দ্রুত বাসায় ফিরতে মাইক্রোবাসে চড়ে বসেন। খানিকটা না যেতেই গাড়ির মধ্যে থাকা এক ব্যক্তি পেছন থেকে তার দুই চোখে মলম লাগিয়ে দেন। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন তিনি। ছিনতাইকারীরা তার মানিব্যাগ থেকে এটিএম কার্ড নিয়ে পঙ্কজের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে পাসওয়ার্ডও জেনে নেয়। পরে তাকে চোখ বেঁধে দুই দিন অজ্ঞাত স্থানে রেখে তিন দিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পেয়ে তিন দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকেন তিনি। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সরাসরি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একটি শাখায় কার্ড হারানোর অভিযোগ দিতে গিয়ে দেখেন অ্যাকাউন্টে কোনো টাকাই নেই। তার লক্ষাধিক টাকা ছিনতাইকারীদের পকেটে।

উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে ভাড়া বাসায় থাকেন গণমাধ্যম কর্মী মনির হোসেন। পত্রিকায় কাজ করায় প্রায় দিনই তাকে রাতে বাসায় ফিরতে হয়। তার অফিস তেজগাঁও শিল্প এলাকায়। উত্তরায় যেতে প্রায় দিনই গাড়ির জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয় তাকে। গণপরিবহন না পেয়ে অনেক সময় উত্তরবঙ্গগামী দূরপাল্লার বাসে চড়ে বাসায় যেতে হয়। মাঝে মাঝে মাইক্রোবাসেও বাসায় ফিরেছেন। ঘটনার দিন রাতে বেতন পেয়েছিলেন মনির। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে তাই নাবিস্কো এলাকা থেকে একটি কালো গ্লাসযুক্ত মাইক্রোবাসে ওঠে বসেন। একই স্থান থেকে তার সঙ্গে আরো দুজন যাত্রী হয়ে গাড়িতে ওঠেন। কিছুটা মনোবল পান মনির। তাদের গাড়িটি কিছু দূর যেতেই একজন স্ন্যাকস জাতীয় খাবার সাধেন। মনির প্রথমে তাতে সায় দেননি।

একপর্যায়ে ওই লোক যখন সবাইকে খেতে দিলেন, তখন মনির আশ্বস্ত হন। পরে তিনিও সেই খাবার খান। এরপর আর কিছুই মনে নেই মনিরের। ঘুম ভাঙার পর দেখেন খিলক্ষেতে রাস্তার পাশে পড়ে আছেন তিনি। তার কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, পকেটে থাকা মোবাইল এবং মানিব্যাগ কিছুই নেই। বুঝতে পারেন তিনি অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়েছিলেন।

এ ছাড়াও কয়েক দিন আগে গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার মামুন নামে এক পোশাক শ্রমিক বেতন নিয়ে গ্রামে যাচ্ছিলেন। গাবতলী যেতে তিনি গাজীপুর থেকে একটি মাইক্রোবাসে চড়েন। পথে আশুলিয়া ধউর বেড়িবাঁধ এলাকায় যাওয়া মাত্রই দেশীয় অস্ত্র ঠেকিয়ে সর্বস্ব নিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। সর্বস্ব নেওয়ার পর তাকে উপর্যুপরি কুপিয়ে আহত করে ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা।

এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে রাতের ঢাকায়। শুধু ঢাকা নয়, দেশের প্রধান শহরগুলোর রাতের রাজপথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভয়ংকর ছিনতাইকারী চক্র। সংশ্লিষ্টরা বলছে, রাজধানীতে কর্মব্যস্ত মানুষের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর অন্যতম সমস্যা হলো যানবাহন স্বল্পতা। আর এ সমস্যা কাজে লাগিয়ে নগরীতে ছিনতাইয়ের ফাঁদ পেতেছে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। মাইক্রোবাসে যাত্রী পরিবহনের নামে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে এই ছিনতাইকারী চক্র। একটু আরামে ও দ্রুত অফিস বা গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়ায় অনেকটা অসাবধানতার কারণে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছেন যাত্রীরা।

তবে পুলিশ বলছে, আগের তুলনায় এ ধরনের ছিনতাইয়ের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। নগরীর বিভিন্ন সড়কের মোড়ে অফিসের শুরুতে বা শেষে হাজারো মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। পাবলিক পরিবহনের আশায় অপেক্ষা করতে হয় তাদের। গন্তব্যে পৌঁছাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগায় ছিনতাইকারীরা। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সামনে মাইক্রোবাস নিয়ে ডাকাডাকি শুরু করে তারা। মাইক্রোবাসে লোক তোলা হয় টার্গেট করে। নির্ধারিত ব্যক্তি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায় মাইক্রোবাস। ছেড়ে যায় গন্তব্যের পথে। মাঝপথে গিয়ে টের পাওয়া যায়, টার্গেট ব্যক্তি ছাড়া বাকি সবার ভয়ংকর রূপ বেরিয়ে আসে।

প্রথমেই টার্গেট ব্যক্তিকে দুই পাশ থেকে দুজন শক্ত করে ধরে বসে। পেছন থেকে বা পাশ থেকে আরেকজন মুখ চেপে ধরে। কাউকে মারধর, কারো চোখে বিষাক্ত মলম ও মরিচের গুঁড়া জাতীয় পাউডার মেখে দেয়। এতে টার্গেট ব্যক্তির চোখে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, অনেকটা বেহুঁশ হওয়ার মতো অবস্থা। একই সঙ্গে চলে শারীরিক নির্যাতন। ছোট ছোট রড জাতীয় বস্তু বা হাতুড়ি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড়ে ও জয়েন্টে আঘাত করা হয়। এরপর কেড়ে নেওয়া হয় সঙ্গে থাকা মোবাইল, মানিব্যাগ, ল্যাপটপ সবকিছু। এ ছাড়া সঙ্গে থাকলে এটিএম কার্ড ও মোবাইল ব্যাংক থেকে টাকাও তুলে নেয় সংঘবদ্ধ চক্র। এরপর সুযোগ বোঝে মাইক্রোবাস থেকে ভুক্তভোগীকে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।

রাজধানীর বনানী, মহাখালী, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, মতিঝিল, নিউমার্কেট এলাকায় বেশ কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। এরা ছিনতাইয়ের কাজে বেশির ভাগ সময় কালো কাচের মাইক্রোবাস ব্যবহার করে থাকে। গাড়ির ভেতরে কী হচ্ছে বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় নেই। পথচারীরা এ ধরনের ঘটনার শিকার হলেও ঝামেলা এড়াতে থানায় কোনো মামলা কিংবা জিডিও করেন না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাসে রাতের মাইক্রোবাসে চড়ে অর্ধশত ব্যক্তি তাদের সর্বস্ব খুইয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে গুরুতর জখম হয়েছেন। তবে এসব ঘটনায় হতাহত কিংবা ভুক্তভোগীরা থানায় কোনো অভিযোগ দেননি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, এ ধরনের ছিনতাইকারী চক্রকে গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি গ্রুপকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। পুলিশের টহলের কারণে এখন এ ধরনের অপরাধ অনেকটাই কমে এসেছে। তবে যাত্রীদের পরামর্শ দিয়ে তিনি জানান, এ ধরনের ছিনতাই রোধে সবার আগে যাত্রীদেরই সচেতন হতে হবে। যে কোনো অপরিচিত মাইক্রোবাসে ওঠা যাবে না। কষ্ট হলেও পাবলিক পরিবহন যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাতের মাইক্রোবাস,ছিনতাইকারী চক্র,মাইক্রোবাস চক্র,অপরাধ জগত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist