জুবায়ের চৌধুরী

  ১৮ মার্চ, ২০১৮

বাইক চুরিতে বেপরোয়া ছিনতাইকারী চক্র

রাজধানী জুড়ে হঠাৎ করেই মোটরসাইকেল চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। গত মাসে দুই ডজন মোটরবাইক চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। বাইক ছিনতাইয়ের ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। তাদের হামলায় নিরাপত্তারক্ষীরাও প্রাণ হারিয়েছেন। মোটরসাইকেল চোর-ছিনতাইকারীরা টার্গেট করে বিভিন্ন বাসায় হানা দিচ্ছে। তাদের এই নতুন কৌশলে আতঙ্কিত মোটরবাইক মালিকরা।

আগে রাস্তায় বা বাইরে রাখা মোটরসাইকেল বেশি চুরি হলেও এখন অপরাধীরা বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে। বাড়ির পার্কিংয়ে রাখা মোটরসাইকেলও তালা ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে তারা। বাধার মুখে পড়লেই নিরাপত্তাকারী বা মোটরসাইকেলের মালিককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করছে। সম্প্রতি সংঘটিত কয়েকটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, চুরি বা ছিনতাইয়ের বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটছে শুক্র-শনিবার, বন্ধের দিনে। গত এক মাসে দুই ডজনের বেশি ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় চোর-ছিনতাইকারীদের হামলায় এক নিরাপত্তাকর্মী নিহত এবং ১২ জন আহত হয়েছেন।

সর্বশেষ গত শুক্রবারও দুটি ঘটনা ঘটে। ভোরে মুগদার মানিকনগরের একটি বাসায় নিরাপত্তা কর্মী মিজান (৫৫) ও একটি ফ্ল্যাটের গৃহকর্মী আবদুল গণিকে (৩০) কুপিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। দুপুরে খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগের উত্তর গোড়ান আদর্শনগের একটি বাড়ির নিচে থেকে মোটরসাইকেলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

ভুক্তভোগীরা বলেছেন, মোটরসাইকেল চুরি বা ছিনতাই হলে সে ঘটনার তদন্ত হয় না। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেই দায় সারে পুলিশ। ছিনতাই হওয়া মোটরসাইকেল উদ্ধারের ঘটনাও কম। তদন্ত ও মামলা না হওয়ায় হাজারো ঘটনা ধামাচাপা পড়ছে। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে কৌশল পাল্টে বাড়িতেই ঢুকছে অপরাধীরা। এ জন্য ছুটির দিনে বেশি বাসার নিচে পার্ক করে রাখা মোটরসাইকেলটির দিকেই টার্গেট অপরাধীদের।

গত ৮ মার্চ রাতে মিরপুরের উত্তর টোলারবাগে মোটরসাইকেল চুরিতে বাধা দিতে গিয়ে খুন হন নিরাপত্তাকর্মী ওমর ফারুক। এ ঘটনায় জড়িতদের কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। তবে চুরি যাওয়া মোটরসাইকেলটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ১০ মার্চ উদ্ধার করে পুলিশ। একই রাতে মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের ‘ই’ ব্লকের নোভা রহমান হাউজিং সোসাইটির একটি বাসায় হানা দেয় ছিনতাইকারী চক্র। সেখানেও মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন নিরাপত্তাকর্মী অপু কুমার সরকার ও আনিসুর রহমান। সম্প্রতি আদাবরের শেখেরটেক ১/১ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়ি থেকে দুই দফায় দুটি মোটরসাইল ও দুটি বাইসাইকেল চুরি হয়েছে। একই এলাকার ফারুক সাহেবের বাড়ি থেকে আরো দুটি বাইক চুরি হয়েছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে আটটি বাইক চুরি হয়েছে ওই এলাকা থেকে।

শেখেরটেকের বাসিন্দা মুঈদ খন্দকার জানান, আদাবরে বাসার ভেতর থেকে বাইক ও বাইসাইকেল চুরির ঘটনা বেড়ে গেছে। এ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পুরো এলাকায়। চুরির দৃশ্য ধরা পড়ছে সিসিটিভির ফুটেজে। সেই ফুটেজ নিয়ে থানায় জিডি কিংবা মামলাও হচ্ছে, কিন্তু চোরের কোনো হদিস দিতে পারছে না পুলিশ। তিনি মনে করেন, পুলিশ আন্তরিক হলে চোর ধরা কোনো ব্যাপারই না।

গত ১০ মার্চ ভোরে খিলগাঁওয়ের উত্তর গোড়ানের ৬৬ নম্বর বাসায় কলাপসিবল গেটের তালা ভেঙে ভেতওে ঢুকে পড়ে তিন দুর্বৃত্ত। সেখানেও একইভাবে তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন নিরাপত্তাকর্মী মনির হোসেন। ওই বাড়ির অদূরে আদর্শবাগে গতকাল দিনদুপুরে ঘটে একই ঘটনা। ভুক্তভোগী নূরে আলম জানান, ৩৫০ নম্বর বাড়ির নিচে তার ডিসকভারি মোটরসাইকেলটি রাখা ছিল। দুপুরে নামাজের সময় লোকজন ছিল না। এ সুযোগে চোর হানা দেয়। পাশের গলির মুখে সিসি ক্যামেরা আছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, একজন লাল গেঞ্জি পরা যুবককে মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যেতে দেখেন তারা। নূরে আলম জানান, চুরির ঘটনায় পুলিশ জিডি নিয়ে তদন্ত করছে। খিলগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাহাঙ্গীর হোসেন খান বলেন, ‘ঘটনাটি আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।’

খিলগাঁওয়ের কাছেই মুগদায় মানিকনগরের ৮২/৮৩ নম্বর নুর ফাতেমা ভবনে গত বৃহস্পতিবার ভোর ৫টায় তিন ছিনতাইকারী ঢুকে পড়ে। রাসেল নামের এক ফ্ল্যাট মালিক জানান, ছিনতাইকারীরা নিরাপত্তাকর্মী মিজানকে চাপাতি দিয়ে এবং গৃহকর্মী আবদুল গণিকে রড দিয়ে আঘাত করে মোটরসাইকেল নিয়ে যায়। টোলারবাগ ও গোড়ানের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, এ দুই এলাকায় কয়েক বছর ধরেই বাড়িতে মোটরসাইকেল চোর-ছিনতাইকারীরা হানা দেয়। মাঝে বন্ধ থাকলেও এখন আবার বেড়েছে।

গত ১০ মার্চ ভোরে হাজারীবাগের বউবাজার এলাকায় নিরাপত্তাকর্মী মুরাদ হোসেনকে ছুরিকাঘাত করে মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালায়। এ সময় ছিনতাইকারী শিবলিকে আটক করে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন স্থানীয়রা। হাজারীবাগ থানার ওসি ইকরাম আলী মিয়া বলেন, শিবলি চিহ্নিত চোর। এর আগেও তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সিন্ডিকেটের সদস্য হলেও সে এককভাবেই অপরাধ করে।

এদিকে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সূত্র জানায়, গত এক মাসে মোটরসাইকেল ছিনতাইকারীদের হামলায় আহত অন্তত ১২ জন সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। কোনো ঘটনায়ই পরে তদন্তে অপরাধী ধরা পড়ার নজির নেই। গত বছরের ১৯ অক্টোবর ধানমন্ডির ৯/এ এলাকার একটি ছয় তলা বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী মেনহাজ উদ্দিনকে (৫০) ছুরিকাঘাত করে মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে ছিনতাইকারীরা। বাড়ির কেয়ারটেকার তৌফিক এলাহী বলেন, এ ঘটনায় একবার পুলিশ এসে খোঁজ নিয়ে যায়। পরে আর কিছুই হয়নি।

অন্যদিকে, পুলিশ সদর দফতরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালের শেষ তিন মাসে রাজধানীতে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটে ৭৮টি। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে সারাদেশে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় ২৯২টি মামলা হয়। একই সময়ে পুরনো ঘটনায় উদ্ধার হয়েছে মাত্র ১৩৫টি মোটরসাইকেল। মামলা না হওয়ায় ঘটনাগুলো পুলিশের এই তথ্যের বাইরে রয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত চলছে। শিগগিরই জড়িতদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মোটরসাইকেল চুরি,মোটরসাইকেল ছিনতাই,বেপরোয়া,বাইক
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist