জুবায়ের চৌধুরী

  ০৭ মার্চ, ২০১৮

অপরাধীদের কল রেকর্ড দিতে অপারেটরদের অনীহা!

রবির প্রধান নির্বাহীকে তলবের সুপারিশ সিআইডির

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপরাধীদের কল রেকর্ড দিতে অসহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে। আদালতের নির্দেশ থাকার পরও মিলছে না প্রত্যাশিত সহযোগিতা। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ তুলে এক সেলফোন অপারেটরের প্রধান নির্বাহীকে আদালতে স্বশরীরে হাজির হয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাখা চাওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

আইশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধ সংঘটিত হওয়া সিমের মালিকের তথ্য সময়মতো সরবরাহ করে না সেলফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো। এজন্য বেশিরভাগ মামলারই নির্ধারিত সময়ে চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানে অল্প সময়ে প্রযুক্তির ব্যবহার করে অপরাধী ধরতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং। আর এটি করতে মোবাইল অপারেটররা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু অপারেটররা তা না করে উল্টো অসহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সিআইডি সূত্র জানান, বেসরকারি একটি ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং ডিভিশনের কর্মকর্তা পরিচয়ে এক গ্রাহককে ফোন করে তার অ্যাকাউন্টের টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মুগদা থানায় একটি মামলা করেন এস এম হুমায়ুন কবির নামের এক ব্যবসায়ী। তদন্ত ভার পেয়ে কাজ শুরু করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এক মাস তদন্তের পর যে ফোন থেকে ওই ব্যবসায়ীর কাছে ফোন করা হয়েছিল তার আইএমইআই সংগ্রহ করে তদন্তকারী কর্মকর্তা। পরে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা উন্নত প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে জানতে পারেন, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত দুটি আইএমইআই নম্বরে গত বছরের অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে ৮৮টি সীম ব্যবহার হয়েছে। এসব সীমের মধ্যে তিনটি সীম দেশের শীর্ষস্থানীয় সেলফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের। বাকি ৮৫টি সীম রবির। ওইসব সীমের নিবন্ধনকৃত এজেন্টের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও ডিস্ট্রিবিউটরের পূর্ণ নাম ঠিকানাসহ সিম নিবন্ধিত গ্রাহকের সত্যায়িত রঙিন ফরম ও কেওআইসি ভোটার আইডির কপি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।

তদন্ত কর্মকর্তার চাহিদার ভিত্তিতে ঢাকার সিএমএম আদালত গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট সেলফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের নির্দেশনা দেন। কিন্তু দুই মাস অতিবাহিত হলেও চাহিদা অনুযায়ী, তথ্য সরবরাহ করা হয়নি। আর এ কারণেই ঝুলে গেছে মামলার তদন্ত কাজ। সেলফোন অপারেটরগুলোর কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা না পেয়ে ডিএমপির উপকমিশনারের (প্রসিকিউশন বিভাগ) মাধ্যমে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি লিখিত সুপারিশ পাঠায় সিআইডি।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পাঠানো ওই সুপারিশে সিআইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ৮৮টি সীমের মধ্যে ৮৫টি সীমের তথ্য চেয়ে সেলফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠান রবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আদালতের আদেশনামা পৌঁছে দেওয়া হয়। গত ২৬ ডিসেম্বর ওই আদেশনামা গ্রহণ করা হলেও চাহিদা অনুযায়ী, তথ্য সরবরাহ করা হয়নি। পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ডেমরা বিভাগের এসআই কামাল হোসেন নিজে রবির প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতার অনুরোধ করেন। কিন্তু এরপরও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে তথ্য দিয়ে কোনো প্রকার সহযোগিতা করা হয়নি।

আদালতের আদেশ থাকার পরও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা না পাওয়ার ঘটনাটিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় ওই সুপারিশে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির এমন অসহযোগিতাপূর্ণ আচরণে মামলার ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্ত কার্যে সহায়তা না করে অপরাধীদের সহযোগিতা করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাই আদালতের আদেশ অমান্য করায় রবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আদালতে স্বশরীরে হাজির হয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাখা চাওয়া যেতে পারে বলেও এতে সুপারিশ করা হয়।

ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, ৮৮টি নম্বরের মধ্যে ৮৭টি নম্বর মোবাইল ব্যাংকিং (রকেট) অ্যাকাউন্ট হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এসব অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে ভুয়া নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যাকাউন্টগুলো ডাচ-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং মিরপুর ও নিলফামারী থেকে অ্যাকটিভ করা হয়। ১৪টি মোবাইল গ্রাহক সিম বর্ণিত মোবাইল নম্বরগুলো একই গ্রুপের হেফাজতে কিভাবে নিবন্ধন করা হয়েছে, তার সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন করা একান্ত প্রয়োজন। এ জন্য পুনরায় তথ্য সরবরাহের আদেশটি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জিএম, রবি ও গ্রামীণফোন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের মোবাইল ব্যাংকিং শাখার ব্যবস্থাপক এবং টেলি যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার চেয়ারম্যান বরারব পাঠানোর জন্য আদালতের কাছে অনুরোধ জানানো হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং ঘিরে বেশ কয়েকটি প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কয়েক স্তরে ভাগ হয়ে এসব চক্রের সদস্যরা কাজ করে থাকে। এদের দ্বিতীয় পর্যায়ে সদস্যরা তথ্য সংগ্রহের কাজটি করে থাকে। এরা মূলত কোন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে, তার বাড়ি কোথায়, কোন নম্বর থেকে তার অ্যাকাউন্টে ক্যাশ ইন হয়েছে- এসব তথ্য সংগ্রহ করে চক্রের অন্য সদস্যদের কাছে সরবরাহ করে। এই কাজটি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ ছাড়া সম্ভব নয় বলেও ধারণা সিআইডির।

তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির ডেমরা ইউনিটের উপপুলিশ পরিদর্শক মো. কামাল হোসেন বলেন, আমরা গ্রামীণফোন ও রবির কাছে তথ্য চেয়েছিলাম। তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রামীণফোন সহযোগিতা করলেও রবির পক্ষ থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা করা হয়নি। এতে করে মামলার তদন্ত কাজ চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে এবং অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

এদিকে, প্রতারণার শিকার ব্যবসায়ী হুমায়ন কবির জানান, তার কাছে একটি অজ্ঞাত নম্বর থেকে আসা ফোনে ভরাট গলায় বলা হয়, আমি ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং ডিভিশন থেকে বলছি। আপনার মোবাইলে রকেট একাউন্টটি বন্ধ হয়ে গেছে। আপনার অ্যাকাউন্ট-সংক্রান্ত সকল তথ্য সঠিক থাকার কারণে আমরা অ্যাকাউন্টটি চালু করে দিলাম।

পরে ওই গ্রাহককে ফোনে আরো বলা হয়, একটি কনফার্মেশন মেসেজ গেছে, দেখতে পাচ্ছেন কি না। জবাবে হুমায়ুন কবির বলেন, মোবাইলে কথা বলছি, তাই মেসেজটি দেখা যাচ্ছে না। তখন অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয়, অন্য একটি নম্বর দেন তাহলে ওই নম্বরে কথা বললে মেসেজটি দেখতে পারবেন। কথা অনুযায়ী, তাকে অন্য একটি নম্বর দেন হুমায়ুন। তখন ওই নম্বরে ফোন দিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিটি ফোনের বিভিন্ন বাটন চাপতে বলেন। নির্দেশনা অনুযায়ী, কাজ করেন হুমায়ুন। কলটি শেষ করার পর তিনি দেখতে পান তার মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের সব টাকা অন্য দুটি অ্যাকাউন্টে চলে গেছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অপরাধী,কল রেকর্ড,রবি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist