জুবায়ের চৌধুরী

  ০৫ মার্চ, ২০১৮

হুমকি দিয়ে বিশিষ্টজনদের ওপর হামলা

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ!

দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ড. জাফর ইকবালের প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছে। সিলেটে তার কর্মস্থল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরেই একটি অনুষ্ঠানে পেছন থেকে হামলা চালায় এক যুবক। ছুরিকাহত অবস্থায় জাফর ইকবালকে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢাকায় সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। তিনি এখন আশঙ্কামুক্ত। অন্যদিকে, হামলাকারীকেও ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয়েছে।

জানা গেছে, আটক যুবক জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই শিক্ষাবিদের ওপর হামলা চালিয়েছে। হামলা চালানোর আগে ওই যুবক জাফর ইকবালের পেছনেই দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করছিল। অনুষ্ঠানে তোলা বিভিন্ন ছবিতে ওই যুবকের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠে। জাফর ইকবালের ঠিক পেছনেই ওত পেতে ছিল যুবক। তার পাশেই ছিলেন দুজন পুলিশ সদস্য। ছবিতে দুই পুলিশ সদস্য মোবাইলের দিকে মনোযোগী ছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে সুযোগ বুঝে হামলা চালায় যুবক। অনুষ্ঠানস্থলে পুলিশ প্রটোকলে কীভাবে ওই যুবক ঢুকে পড়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কারণ, গত তিন বছর ধরে ড. জাফর ইকবাল জঙ্গিদের টার্গেটে ছিলেন। একাধিকবার তাকে চিঠি পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। তারপর থেকেই সরকার তাকে পুলিশি নিরাপত্তায় রেখেছিল। কিন্তু গত শনিবার এই নিরাপত্তার মধ্যেই তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরেই ড. জাফর ইকবাল এবং তার স্ত্রী অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হককে একাধিকবার হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের অক্টোবরে জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) পরিচয়ে ফোনে হত্যার হুমকির পর জালালাবাদ থানায় জিডি করেন এই দম্পতি। আগের বছর ২০১৫ সালে শাবিপ্রবিতে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে সস্ত্রীক সক্রিয় ছিলেন তিনি। সে সময় তার স্ত্রীসহ অন্য শিক্ষকরা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন জাফর ইকবাল। র‌্যাগিংয়ের দায়ে পাঁচ ছাত্রের শাস্তি দেওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, এদের শাস্তি কম হয়েছে, তাদের পুলিশে দেওয়া উচিত।

এর আগেও দেশে বিশিষ্টজনদের টার্গেট করে জঙ্গি হামলা হয়েছে। বিশিষ্ট কবি শামসুর রাহমান ও অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপরও নৃশংস হামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে শামসুর রাহমান বেঁচে ফিরলেও হুমায়ুন আজাদকে বাঁচানো যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক মুক্তমনা লেখক-ব্লগারদের ওপরও নৃশংস হামলা হয়েছে। এসব হামলায় নিহত হয়েছেন অনেকে। হামলার আগে হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠিও পাঠিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। বেশিরভাগ হুমকি এসেছিল বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নামে। থানায় জিডি, হুমকিদাতা গ্রেফতার এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও থেমে নেই প্রাণনাশের চেষ্টা। একের পর এক হত্যাকান্ডের পর বেনামি চিঠিতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বিচারক, মন্ত্রী, এমপি, অ্যাটর্নি জেনারেল, পুলিশ কর্মকর্তাসহ বিশিষ্টজনদের। কখনো ফেসবুকে, মোবাইলে এসএমএস, কখনো ই-মেইলে, কখনো বা ডাকের চিঠিতে; আবার কাফনের কাপড় পাঠিয়েও হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো ঘটনারই রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জঙ্গিরা।

ধারাবাহিক প্রাণনাশের এই হুমকি নিয়ে বিশিষ্টজনরা বলেন, জঙ্গিগোষ্ঠী এখন পর্যন্ত যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সেগুলোর যদি সুষ্ঠু তদন্ত এবং দ্রুত বিচার হতো তা হলে আজকে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের এবং ধর্মযাজকদের হত্যার হুমকি দিতে সাহস পেত না সন্ত্রাসীরা। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, র‌্যাবের বিভিন্ন দল হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে হুমকিদাতাদের গ্রেফতার অব্যাহত রেখেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কৌশল বলতে কিছু নেই। টার্গেট কিলিং রোধে ছোট ছোট গ্রুপগুলো শনাক্ত করতে এবং আগাম গোয়েন্দা তথ্য তারা বের করতে পারছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও জাফর ইকবালসহ ১৫৩ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে আবদুল হক এবং নাহিদ হাসানকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা। গ্রেফতারের পর এদের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিল আইএস।

২০১৬ সালের ১২ জুন কে বা কারা জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে কাফনের কাপড় পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। গত তিন বছরে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে দুই শতাধিক বিশিষ্ট নাগরিককে। হত্যার হুমকি থেকে বাদ যাননি প্রধানমন্ত্রীপুত্র ও তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও। একই বছরের ৫ জুন চট্টগ্রামে খুন হওয়া মাহমুদা খানম মিতুর স্বামী এসপি বাবুল আক্তারসহ অন্তত চারজনকে হত্যার হুমকি দিয়ে দেড় মাস আগে চিঠি দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা।

২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। একই বছরের ১৪ এপ্রিল আইনমন্ত্রী আনিসুল হককেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ছাত্রশিবিরের প্রবাসী এক নেতা এই হুমকি দিয়েছেন বলে পুলিশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। তবে সেই প্রবাসীকে গ্রেফতারে কোনো তৎপরতা নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। ওই বছরের ২১ মে ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনীতিবিদ এইচটি ইমামসহ ১০ জনকে হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠির নিচে প্রেরকের নাম দেওয়া আছে ‘আল কায়দা আনসারুল্লাহ বাংলা ১৩’।

চিঠিতে যে ১০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট অসীম সরকার, প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম ও সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম ও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। একই বছরের ২ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, অভিনেত্রী শমী কায়সারসহ সাতজনকে হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল আল কায়দা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১৩।

২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে মোবাইলে এসএমএস করে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এরপর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, রাজশাহীর আওয়ামী লীগ নেতা এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকসহ বিশিষ্ট আট ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। আনসার আল ইসলাম (আল কায়দা ভারতীয় উপমহাদেশ) নামের সংগঠনটির প্যাডে এই হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। চিঠিতে রাজশাহীর দৈনিক সানশাইনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ইউনুস আলীকেও ওই আটজনের তালিকায় রাখা হয়েছে। একই বছরের ৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে দুই যাজককে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে জেএমবির নামে। এর আগে একই বছরের ২৬ নভেম্বর রংপুরে ১০ ধর্মযাজককে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার ব্যাপারে অনেক অভিযোগ থাকলেও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা খুব বেশি শোনা যায়নি। ওই বছরের নভেম্বরে পাবনায় যাজক লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করা হয়। দিনাজপুরে আরেক যাজক ইতালীয় নাগরিক পিয়েরা পারোলারির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি।

এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের প্রতিবাদ মঞ্চ (গণজাগরণ মঞ্চ) তৈরি হয়। পরে এই আন্দোলনে যুক্ত হয় বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। শাহবাগে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামী সংগঠনও মাঠে সক্রিয় হয়। তখন থেকে কিছু ব্লগারকে কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। ওই বছরের ৩১ মার্চ ৮৪ ব্লগারদের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় হেফাজতে ইসলাম। এর আগে ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের অন্যতম সদস্য ব্লগার রাজীব হায়দার শোভনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। এরপর ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানমনস্ক লেখক মার্কিন নাগরিক ড. অভিজিৎ রায়কে টিএসসির জনবহুল এলাকায় হত্যা করে উগ্রপন্থীরা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী,হুমকি,বিশিষ্টজনদের ওপর হামলা,অপরাধ,টার্গেট কিলিং
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist