জুবায়ের চৌধুরী

  ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

অনলাইনে জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি : শঙ্কিত খোদ গোয়েন্দারা

অনলাইনে জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অনেক তরুণ-তরুণীই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জঙ্গিবাদের বিভিন্ন পোস্ট, ভিডিও দেখে তাতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। অনলাইনে জঙ্গিবাদের এমন বিস্তৃতিতে শঙ্কিত খোদ গোয়েন্দারাই! সম্প্রতি দেশ ও বিদেশ থেকে দুই বোনকে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে অনলাইনে বিভিন্ন ‘জিহাদি’ ভিডিওচিত্র দেখে তাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার বিষয়টি। তবে তারা বিশেষ কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য হননি।

বাংলাদেশে অনেকে একা একা অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে হামলা চালাচ্ছে বলে দাবি করেছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এটা জঙ্গিবাদে জড়ানোর ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান বলেন, ‘বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের যেসব বক্তব্য বা বিবৃতি অনলাইনে আছে তা সংগ্রহ করে র‌্যাডিক্যালাইজড হয়ে অনেকে হামলা চালাচ্ছে। এটাকে জঙ্গিবাদে জাড়ানোর নতুন মাত্রা হিসেবে দেখছি আমরা। এই দুই বোনই অনলাইন মাধ্যম থেকে ‘সেলফ র‌্যাডিক্যালাইজড’ বা ‘স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উগ্রপন্থার চর্চা’ করেছেন।

গত ১১ ফেব্রæয়ারি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে একজন নার্সকে ছুরিকাঘাত করার অভিযোগে বাংলাদেশি ছাত্রী মোমেনা সোমাকে (২৪) গ্রেফতার করে সেখানকার পুলিশ। পরে জানা যায়, ‘ইসলামিক স্টেট-আইএসের আদর্শে অনুপ্রাণিত’ হয়ে ২৪ বছর বয়সী সোমা তাদের বাসায় ঘুমন্ত রজার সিঙ্গারাভেলুর ওপর ওই হামলা চালান বলে অভিযোগ করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির পাঁচ বছরের মেয়ে জানিয়েছে, হামলা করার সময় সোমা বোরকা পরেছিল। সোমাকে ‘স্বতঃপ্রণোদিত জঙ্গি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে একটি সন্ত্রাসী হামলা চালানোর অভিযোগ আনা হয়। আক্রমণ করার আগে সোমা সিঙ্গারাভেলুর সঙ্গে মাত্র একদিন একই বাসায় বসবাস করেন।

এদিকে বাংলাদেশে সোমার পরিবারের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তদন্তের এক পর্যায়ে সোমার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গত সোমবার রাতে মিরপুরে তাদের বাসায় যান কর্মকর্তারা। এ সময় পুলিশের এক কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাত করেন সোমার বোন আসমাউল হুসনা সুমনা (২২)। তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত মহিলা পুলিশের সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। সন্ত্রাস দমন আইনে দায়ের করা মামলায় সুমনাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

জিজ্ঞাসাবাদে সুমনা জানিয়েছে, বছর দুয়েক আগে বড় বোন সোমার হাত ধরেই উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। তারা দুজনই নব্য জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত। দুই বোন মিলে প্রায়ই অনলাইনে জিহাদি ভিডিও দেখতেন। এছাড়া সুমনাকে ছুরি চালানোর প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন সোমা।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, সোমা ও সুমনা দুই বোনই সেলফ মোটিভেটেড উগ্রপন্থী। দেশীয় জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা মিললেও বাইরের কোনো সংগঠনের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুমনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছে।

যেভাবে উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়ে দুই বোন : তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মোমেনা সোমা ২০০৯ সালে ঢাকার লরেটো স্কুল থেকে ‘ও’ লেভেল এবং ২০১১ সালে মাস্টারমাইন্ড স্কুল থেকে ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করেন। ২০১২ সালে তিনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে পড়ার সময়ই ২০১৪ সালে উগ্রপন্থায় জড়ান সোমা। ওই বছরই সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দেয়ার চেষ্টা করেন। এজন্য তুরস্কের একটি ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ জোগাড় করেন। কিন্তু ঢাকায় তুরস্ক দূতাবাস তাকে ভিসা না দেওয়ায় তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। পরে গত ১ ফেব্রæয়ারি সোমা লা ট্রোব ইউনিভার্সিটিতে ভাষা বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যায়নের জন্য মেলবোর্নে পৌঁছান। বিশ্ববিদ্যালয়টি তাকে ‘এক্সেলেন্স’ বা লেখাপড়ায় উৎকর্ষের জন্য ২৫ শতাংশ বৃত্তি দিয়েছিল।

অন্যদিকে, সুমনা মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন গ্রিনফিল্ড কলেজে। ওই কলেজ থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এইচএসসিতে অকৃতকার্য হন সুমনা। পরে ২০১৭ সালে ম্যানটরস থেকে জিইডি শেষ করে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে (ইউল্যাব) ইংরেজিতে ভর্তি হন। জিয়াম্যান নামে একটি মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠানে পড়তে বৃত্তি পান সুমনা। তবে অসুস্থতার কারণে সেখানে যাওয়া হয়নি তার। এরপর ট্যুরিস্ট ভিসায় অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেও পরিবারের সম্মতি না পাওয়ায় তার সেখানেও যাওয়া হয়নি।

সোমা-সুমনাদের পরিবার আহলে হাদিসের অনুসারী : সোমা ও সুমনার বাবার নাম মো. মনিরুজ্জামান। তিনি জনতা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত। তাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। ঢাকায় পূর্ব কাজীপাড়ার ৩৫৫/১ নম্বর রয়েল অ্যারোমা গার্ডেনে নিজ ফ্ল্যাটে থাকেন তারা। মনিরুজ্জামান জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, তাদের পরিবার আহলে হাদিসের অনুসারী। তবে দুই মেয়ের উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে কিছুই জানতেন না তিনি। বছর দুয়েক আগে তার দুই মেয়ের বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটে। মনিরুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত বুধবার ছেড়ে দেওয়া হয়।

সিরিয়ায় যাওয়া নজিবুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সোমার : জঙ্গিবাদে জড়িয়ে সিরিয়ায় চলে যাওয়া নজিবুল্লাহ আনসারীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় নার্সকে ছুরিকাঘাত করে গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশি ছাত্রী মোমেনা সোমার সম্পর্ক ছিল বলে জানিয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে সিরিয়ায় চলে যাওয়া নজিবুল্লাহ আনসারীর সঙ্গে সোমার সম্পর্ক ছিল। তাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নজিবুল্লাহর পরিবার রাজি না থাকায় ওই বিয়ে হয়নি। হয়তো ওই সময়ই সোমা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন।

২০১৫ সালে সোমার মা মারা যাওয়ার পর তা আরও তীব্র হয়। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নজিবুল্লাহ আনসারী দীর্ঘ তিন বছর নিখোঁজ রয়েছেন। ওই ঘটনায় তার বাবা নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য রফিকুল্লাহ আনসারী ২০১৬ সালের ১০ জুলাই চট্টগ্রাম ইপিজেড থানায় জিডি করেন।

জিডিতে তিনি বলেন, ওই বছরের জানুয়ারিতে নজিবুল্লাহ তার ভাইকে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে লেখেন যে, তিনি আইএসে যোগ দিয়ে ইরাকে চলে গেছেন। আর ফিরবেন না। নজিবুল্লাহ মালয়েশিয়া মেরিন একাডেমি থেকে পাস করেছিলেন। এরপর আমেরিকায় প্রশিক্ষণ নিয়ে সমুদ্রগামী জাহাজে চাকরি নিয়েছিলেন।

সোমা-সুমনা দুই বোনের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল বলেন, মোমেনা সোমা ও তার বোন আসমাউল হুসনা সুমনা অনলাইনের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন। তবে এই দুই বোন সুনির্দিষ্ট কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছেন কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সুমনাকে জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য জানিয়ে মনিরুল বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে সুমনা জানিয়েছে তার বোন সোমা অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে একটি হামলা করবে এমন তথ্য সে আগেই জানতো। তার প্রতি সোমার নির্দেশ ছিল বাসায় পুলিশ এলে তাদের ওপর হামলা করার। দেশের কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে দুই বোনের যোগাযোগ ছিল কিনা জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, কোনো জঙ্গি সংগঠন বা হলি আর্টিজানে হামলাকারী কারও সঙ্গে তাদের যোগাযোগের প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জঙ্গি,অনলাইনে জঙ্গিবাদ,সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম,জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist