জুবায়ের চৌধুরী

  ১৮ জানুয়ারি, ২০১৮

হিমঘরে চাঞ্চল্যকর ১৫ হত্যা রহস্য!

রহস্য উদঘাটনে বাধা | ক্ষতিগ্রস্ত আলামত

রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের কারণ জানা তো দূরের কথা, কোনো কূল-কিনারাও করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যের বিষয় হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডগুলোর অধিকাংশই হয়েছে বাড়ির ভেতরে। দুই বছর আগে রাজধানীর রামপুরায় মহানগর আবাসিক এলাকার নিজ বাসাতেই আইনজীবী ফাহমিদা আক্তারের হাত-পা বাঁধা লাশ পাওয়া যায়। সেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য আজো উদ্ঘাটন হয়নি। নিহতের স্বজনরা বলেছেন, ফাহমিদা রাস্তা-ঘাটে নয়, খুন হয়েছে নৃশংসভাবে বাসার ভেতর।

অথচ দুই বছরেও তারা জানতে পারলেন না, কারা তাকে খুন করেছে, কেন করেছে। তদন্ত কর্মকর্তারাও তাদের সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ করেন না। শুধু ফাহমিদা নন, গত পাঁচ বছরে রাজধানীর বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের মধ্যে কমপক্ষে আটটি বাসার ভেতরে ১৫ জন খুন হওয়ার ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ঘটনার পর গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, এখনো এসব চাঞ্চল্যকর মামলার কার্যক্রম আটকে আছে তদন্ত সংস্থার কেস ফাইলেই। একেবারে হিমঘরে। সেখান থেকে হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কোনো কোনো মামলায় একাধিকবার তদন্ত সংস্থা বা তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন। তাই বিচার তো দূরের কথা, এখনো জানা যায়নি কেন একজন মানুষ তার নিরাপদ আশ্রয় ঘরের মধ্যেই খুন হয়েছেন। শুধু দীর্ঘশ্বাসই ভারী হচ্ছে নিহতদের স্বজনদের। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, মামলাগুলোর তদন্ত সঠিকভাবেই চলছে।

চাঞ্চল্যকর ১৫ হত্যাকাণ্ড : বাসার ভেতর খুনগুলোর মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী অন্যতম একটি ঘটনা হলো ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সংঘটিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা। একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর হাজারীবাগের বাসায় স্কুলছাত্রী তাসনিম রহমান করবীকে শ্বাসরোধে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট দিন-দুপুরে রামপুরার ওয়াপদা রোডের বাসায় গুলি করে হত্যা করা হয় সিআইডির অবসরপ্রাপ্ত এএসপি ফজলুল করিমকে। ২১ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার গোপীবাগে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় কথিত পীর লুৎফোর রহমান ফারুক, তার ছেলেসহ ছয়জনকে।

পরের বছর ২৭ আগস্ট টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী খুন হন পূর্ব রাজাবাজারে নিজের বাসায়। ২০১৫ সালের ১৩ মে পল্লবীতে নিজের ফ্ল্যাটে খুন হন গৃহবধূ সুইটি আক্তার ও তার মামা আমিনুল ইসলাম। একই বছরে বাসা থেকে উদ্ধার হয় আইনজীবী ফাহমিদা আক্তারের হাত-পা বাঁধা লাশ। গত বছর এক নভেম্বর মগবাজারের মধুবাগে বাসার ভেতর গলা কেটে হত্যা করা হয় ডলি রানী বণিক নামের এক গৃহবধূকে।

নিহত ওই ১৫ জনের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে রহস্য উদ্ঘাটন না হওয়ার পেছনে তদন্ত সংস্থাগুলোর গাফিলতি ও ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন তারা। ঘটনাগুলোর মধ্যে গোপীবাগের ছয় খুনের মামলা তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অন্য নয়টি হত্যা মামলা থানা, ডিবি হয়ে এখন তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে সিআইডি। মামলাগুলোর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এগুলোর বেশিরভাগই ক্লুবিহীন খুন।

এ ধরনের মামলার রহস্য উদ্ঘাটনে সময় লাগতে পারে। তা ছাড়া অনেক ঘটনায় ঠিকমতো আলামত সংগ্রহ করা হয়নি বা ঘটনাস্থলেই নানা কারণে আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। সংগৃহীত আলামতও পর্যাপ্ত নয়। তাই আসামি চিহ্নিত করতে না পারায় কোনো কোনো মামলার তদন্ত মাঝপথে গিয়ে আটকে আছে। তারা আরো বলেন, নতুন নতুন ঘটনার তদন্ত সামাল দিতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর পুরনো মামলাগুলোর তদন্তে তারা সেভাবে সময় দিতে পারছেন না। তদন্ত না এগোনোর এটিও অন্যতম কারণ।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পুরনো মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তারা দেখতে পেয়েছেন, দীর্ঘদিনে খুনের ঘটনাস্থলও আর আগের মতো নেই। খুনের পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুই তারা পাচ্ছেন না। শুরুতে খুনের নেপথ্যে যাদের সন্দেহ করা হতো, দীর্ঘদিনে তাদের ব্যবহৃত নানা ডিভাইসেও পরিবর্তন এসেছে। এতে প্রযুক্তিগত তদন্তও খুব একটা কাজে আসছে না। কোনো কোনো ঘটনায় খুনি শনাক্ত হলেও অবস্থান পরিবর্তন করায় খুঁজে পাওয়া যায় না।

সাগর-রুনি হত্যায় ৪৮ ঘণ্টার আশ্বাসেই পার পাঁচ বছর : সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন আশ্বাস দিয়েছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হবে। সেই আশ্বাসের ঘণ্টা, মাস শেষ হয়ে পাঁচ বছর পেরিয়ে আসছে ফেব্রুয়ারিতে ছয় বছরে পৌঁছবে। থানা পুলিশ, ডিবি হয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে চাঞ্চল্যকর মামলাটি এখন তদন্ত করছে র‌্যাব। এই জোড়া খুনে র‌্যাব-পুলিশ নিহত রুনির একজন বন্ধু, বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী ও কয়েক পেশাদার চোর মিলিয়ে গ্রেফতার করেছে আটজনকে। যদিও হত্যারহস্য এখনো অজানা।

শিশুর খুনিও অধরা : পাঁচ বছর আগে হাজারীবাগের বাসায় স্কুলছাত্রী তাসনিম রহমান করবীকে (১২) শ্বাসরোধ ও গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল। ওই ছাত্রী কেন খুন হলো তা আজো জানতে পারেননি তার বাবা-মা। মা আফরোজা ফারহানা বলেন, পুলিশ তো অনেক বড় বড় অপরাধী ধরে, এটি কেন পারছে না? নাকি তাদের কোনো আগ্রহ নেই? এদিকে, মামলার তদারক কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আখতারুজ্জামান বলেন, ঘটনার প্রায় সাড়ে চার বছর পর মামলাটি সিআইডিতে এসেছে। এতদিনে অনেক আলামতের পরিবর্তন হয়েছে। এজন্য নতুন করে তদন্ত করতে গিয়ে সময় লাগছে।

চার্জশিট হয়নি গোপীবাগের ৬ খুনের : চার বছর আগে গোপীবাগে বাসার মধ্যে নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হন লুৎফোর রহমান ফারুকী, তার বড় ছেলেসহ ছয়জন। লুৎফোর নিজেকে পীর দাবি করতেন। নিহত অন্য চারজনও তার অনুসারী ছিলেন। ঘটনার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করে আসছে, উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে খুন হয়েছেন তারা। তবে এখনো মামলার অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তাও পরিবর্তিত হয়েছে কয়েক দফা। এর মধ্যে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির ছয়জনকে গ্রেফতার করা হলেও উদ্ঘাটন করা যায়নি রহস্য।

মাওলানা ফারুকী হত্যার তদন্তে নতুন মোড় : ফারুকী হত্যায় ডিবি পুলিশের তদন্তে জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তবে মামলাটি এখন তদন্ত করছে সিআইডি। তদন্ত সংস্থা বদল হলেও তিন বছরে তদন্ত ঠেকে আছে একই জায়গায়। ফারুকীর ছেলে আহমেদ রেজা জানান, তারা ভেবেছিলেন, খুনি তাড়াতাড়িই ধরা পড়বে। কিন্তু তিন বছরেও কিছু হলো না।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আরশাদ আলী বলেন, এখন পর্যন্ত ওই মামলায় বিভিন্ন সংস্থা আটজনকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দেওয়ার মতো তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে নেই। এজন্য মামলাটি তিনি শুরু থেকে তদন্ত করছেন। আগের তদন্ত সংস্থা হত্যার নেপথ্যে জঙ্গি সম্পৃক্ততার কথা বললেও তিনি ফারুকীর পরিবারে সম্পত্তিগত, অর্থনৈতিক বা পারিবারিক কোনো কোন্দল ছিল কি না, তাও তদন্ত করছেন।

সন্দেহেই ঘুরপাক খাচ্ছে পল্লবীর জোড়া খুন : পল্লবীতে ফ্ল্যাটে সংঘটিত সুইটি আক্তার ও তার মামা আমিনুল ইসলাম হত্যা মামলা থানা পুলিশ ও ডিবির পর এখন তদন্ত করছে সিআইডি। তবে তিনটি সংস্থারই সন্দেহ নিহত সুইটির স্বামী, ডেসকোর উপসহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলামের ওপর। তবে এ সন্দেহ প্রমাণ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য নেই। অবশ্য সুইটির স্বামী জাহিদুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন সময়ে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তদন্ত সংস্থাগুলোকেও তিনি সব রকম সহায়তা করছেন। এর পরও তিনি জানতেও পারছেন না, বাসায় ঢুকে তার স্ত্রী ও মামাকে কারা, কেন খুন করল। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এসআই মোফাজ্জল হোসেন বলেন, বেশ কয়েকটি ক্লু ধরে তিনি মামলার তদন্ত কার্যক্রম চালালেও এখনো রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেননি। অনেক আলামত নষ্টও হয়ে গেছে।

আইনজীবী হত্যায় অন্ধকারে পুলিশ : দুই বছরে পুলিশ শুধু এটুকুই নিশ্চিত হতে পেরেছে, রামপুরার মহানগর আবাসিক এলাকার বাসায় আইনজীবী ফাহমিদাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে সেই খুনের পরিকল্পনা কার বা কেন এই খুন, সে বিষয়ে অন্ধকারে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। ফাহমিদা সাবেক রাষ্ট্রদূত ও ইত্তেফাকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক প্রয়াত আখতার-উল-আলমের মেয়ে। তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আলী আজম বলেন, শুরুর দিকে হত্যাকা-টিকে ডাকাতদের কাজ মনে হলেও খানিকটা তদন্তের পর মনে হচ্ছে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। তবে সময় চলে যাওয়ায় অনেক আলামত নষ্ট হয়ে গেছে।

তদন্তে অনাস্থা সিআইডি কর্মকর্তার পরিবার : নিহত ফজলুল করিম ছিলেন সিআইডির সাবেক এএসপি। অবসর জীবনে রামপুরার বাসায় থাকতেন। সেখানেই তাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। পরিবারের অন্য সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মুখোশ পরা তিন অস্ত্রধারী তাকে গুলি করে হত্যা করে। তবে আজো খুনিদের সেই মুখোশ উন্মোচন হয়নি। পুলিশ কয়েকজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দিলেও তাতে আস্থা রাখতে পারেনি নিহত পুলিশ কর্মকর্তার পরিবার। সেই চার্জশিটে আদালতে নারাজি দিয়েছে। নতুন করে সিআইডি মামলার তদন্ত করছে।

ডলি হত্যার কারণ অজ্ঞাত : মগবাজারের বাসা থেকে গৃহবধূ ডলি রানী বণিকের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। পাশে পাওয়া গিয়েছিল রক্তমাখা বঁটি-দা। পুলিশ একে আত্মহত্যা বলে ধারণা করলেও ময়নাতদন্ত আর ফরেনসিক প্রতিবেদনে তা পাল্টে যায়। অবশ্য ডিবি পুলিশ খুনের কারণ আর আসামি খুঁজে না পেয়ে সেই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদনও দেয়। স্বজনরা নারাজি দিলে শুরু হয় নতুন তদন্ত। মামলাটি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে। তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রতন কৃষষ্ণ নাথ বলেন, তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর খুনের ক্লু ও খুনি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। যদিও এর মধ্যে অনেক আলামতই নষ্ট হয়ে গেছে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আলোচিত হত্যাকাণ্ড,চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড,সাগর-রুনি হত্যা,খুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist