রিহাব মাহমুদ
অভিযানে কক্সবাজার প্রশাসন
ভেজাল আচার : অন্তরালে কলকাটি নাড়ছেন মূল হোতারা
অবশেষে কক্সবাজারে ভেজাল আচার তৈরির কারখানা বন্ধের মিশনে নেমেছে স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু অভিযোগ, সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের নিরাপদে রেখে নিচের দিকের ভেজাল আচার ব্যবসায়ীর কারখানায় নিস্ফল অভিযান চালানো হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে এই প্রতিবেদক কক্সবাজার ভ্রমণকালে নকল আচার তৈরির কারখানার খবর পেয়ে গোপন অনুসন্ধান শেষে এ নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে। গত মাসে দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদে ‘নকল আচারে সয়লাব কক্সবাজার- প্যাকেটে বালু তৈরি হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে’ এবং ‘কমেনি ভেজালের দৌরাত্ম্য, পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ!’ শিরোনামে প্রিন্ট সংস্করণে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাছাড়া অনলাইন সংস্করণে নিয়মিত বেশ কয়েকটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়। এইসব রিপোর্ট প্রকাশের প্রেক্ষিতে কক্সবাজারের স্থানীয় অনলাইন ও কিছু দৈনিকে এ নিয়ে রিপোর্ট তৈরি হতে থাকে। যার ফলে টনক নড়ে স্থানীয় প্রশাসনের। জানা গেছে, গত ৩০ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় কলাতলীতে একটি ভেজাল আচার তৈরির কারখানায় অভিযান চালান কক্সবাজার সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দিন। এ সময় ২০ বস্তা পচা বরই ও ১৫ বস্তা বার্মিজ ভাষায় লেখা ভুয়া প্যাকেট ও স্টিকার দিয়ে তৈরি আচার জব্দ করার পর পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয় বলে জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দিন।
এরপরও ভেজাল আচার তৈরির মূল হোতারা বিন্দুমাত্র দমে যাননি। জানা গেছে, ভেজাল আচার তৈরির কারখানার মালিক কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ জন। এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ২১টি আচার তৈরির কারখানা কক্সবাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অভিযোগ, সিন্ডিকেটের মূল হোতারা স্থানীয় সাংবাদিক ও প্রশাসনকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে এই অবৈধ ব্যবসা করে আসছে। কখনো মাসোহারা দিতে অপারগতা দেখালে তাদের বিরুদ্ধে একটি মহল অভিযানের ব্যবস্থা করে বলে গোপন সূত্রে জানা গেছে।
পূর্বের রিপোর্ট অনুযায়ী, পর্যটন নগরী কক্সবাজার এখন নকল পণ্যে সয়লাব। কক্সবাজার শহর ও শহরতলিতে ভেজাল আচার তৈরির জন্যই গড়ে উঠেছে অন্তত ২১টি নকল কারখানা। যার কোনো অনুমোদন নেই। এমনকি নকলের ভিড়ে আসল চেনা কষ্টকর হয়ে পড়েছে পর্যটকদের কাছে। নকলের ঠেলায় আসল পণ্য উধাও হওয়ায় ভেজাল আচার কিনে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন পর্যটকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজারে ভেজাল আচার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ও ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ভেজাল আচার তৈরির কারখানার মালিক ও বিক্রেতাদের আটক-পরবর্তী সাজা দেওয়া হয়েছিল। কিছুদিনের জন্য তৎপরতা বন্ধ হলেও পর্যটন মৌসুমের শুরু থেকে বেড়ে গেছে এদের তৎপরতা। এই পর্যটন মৌসুম শুরুর আগেই বিক্রির জন্য এসব ভেজাল আচার তৈরির কারখানায় এবং আচার বিক্রির দোকানগুলোয় মজুদ করা হয়েছে অন্তত ১০ কোটি টাকার হরেক রকমের ভেজাল আচার।
সৈকতের লাবণী পয়েন্টের ছাতা ও ঝিনুক মার্কেটে, সুগন্ধা পয়েন্ট, কলাতলি পয়েন্ট, শহরের বিভিন্ন মার্কেটে, হোটেল-মোটেল জোনসহ পর্যটক সমাগম এলাকায় বিক্রি হচ্ছে ভেজাল আচার। এসব আচারের স্থায়িত্ব রক্ষার নামে ব্যবহৃত হচ্ছে রং, কেমিক্যাল ও ক্ষতিকর ফরমালিন। বার্মিজ মার্কেট, সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা পয়েন্ট ও হোটেল-মোটেল জোন ঘুরে দেখা গেছে, অর্ধশতাধিক দোকানে এসব ভেজাল আচার মজুদ করে রাখা হয়েছে।
সিন্ডিকেটে আছে- খাইরুল আমিন (দক্ষিণ বাহারছড়া), আমিন (বাহারছড়া), বউ করিম (বিজিবি ক্যাম্প, ঝিলংঝা), মো. ইউনুস (লার পাড়া, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল), পুতু (দক্ষিণ ডিককুল, ঝিলংঝা), নেজাম উদ্দিন (লারপাড়া), মো. রহিম (লারপাড়া), মো. ফরহাদ (লারপাড়া), নুরুল আজিম (পূর্ব লারপাড়া), নরুল আলম (কলাতলী) ও মো. হাফেজ (খুরুস্কুল)। এরা ছোট ছোট খুপড়ি ঘরে এসব নকল আচার তৈরির কারখানা গড়ে তুলে অবাধে ব্যবসা করে আসছে। মূলত খাইরুল আমিন, ফরহাদ, রহিম, নুরুল আলম, নরুল আজিম ও হাফেজরাই এই সিন্ডিকেটের গডফাদার বলে স্থানীয়রা জানান।
এদের মধ্যে খাইরুল আমিনের বাড়ি দক্ষিণ বাহারছড়ার কবরস্থান পাড়া। বাবার নাম মৃত আবুল হোছেন। মহেশখালি থেকে কক্সবাজারে এসে প্রথমে দোকানে চাকরি করতেন। এখন অনেক বড় ব্যবসায়ী। সী বিচে তার একটা আচারের দোকান আছে, নাম আয়াত স্টোর। জানা গেছে, পূর্বে ভেজাল আচারসহ তিনি একবার পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন। পরবর্তীতে আবার আটক হন ইয়াবাসহ। কিন্তু বেশিদিন পুলিশের হেফাজতে থাকেননি।
আরও জানা গেছে, এই মূল হোতাদের আড়াল করতে একটা মহল কারখানায় অভিযানের ব্যবস্থা করে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজার শহর ১নং ওয়ার্ড ফদনার ডেইল এলাকায় ভেজাল আচার কারখানায় অভিযান চালান জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পর্যটন সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাইফুল ইসলাম জয়। অভিযানে ভুয়া স্টিকারের প্যাকেটে ভর্তি বিপুল পরিমাণ নকল আচার জব্দ করার পর ধ্বংস করা হয়। জানা গেছে, এই কারখানার মালিক জসিম। যে কিনা অল্প টাকার ব্যবসায়ী এবং বড় কোনো মাসোহারা দিতে পারে না। রাঘব বোয়ালদের বাঁচাতে গিয়ে পুঁটি মাছের ডেরায় হানা দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে স্থানীয় একটি মহল।
এ ব্যাপারে কথা হয় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমরা একটা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়েছি। আপনার কাছে যদি আরো তথ্য থাকে তাহলে আমাদের বলেন। আমরা অন্যদের বিরুদ্ধেও অভিযানের ব্যবস্থা করবো।
জানা গেছে, সিন্ডিকেটের হোতারা এক জায়গায় তাদের কারখানা রাখে না। কখনো লারপাড়া, আবার কখনো কোটবাজার, কখনোবা খুরুস্কুল অথবা কালুর দোকান। এভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গড়ে উঠা খুপড়ি ঘরে তাদের ভেজাল আচার তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা গেছে, বর্তমানে রহিম, ফরহাদরা লারপাড়া এলাকার নতুন জেলখানার পাশে একটি কারখানায় তাদের এই অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার সদর থানার ওসি রনজিত কুমার বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, দুইবার অভিযান চালানো হয়েছে। এখনো কাউকে আটক করা যায়নি। তবে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে আশা করি। আমরা মূল হোতাদের আটক করার ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাবো।