পঞ্চানন মল্লিক
পাঠ
হারিয়ে যাচ্ছে বই পড়া!
কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর বইপড়া প্রবন্ধের আবেদন আজ উপেক্ষিত। আধুনিক নেট কেবলের যুগে বই পড়া তো দূরে থাক, বই নিয়ে ভাবার লোকের সংখ্যাও যেন খুবই কম। উদাসীনতা, অনাগ্রহ যেন ভর করেছে পাঠকের মননে-চিত্তে। এককালে বইয়ের লেখকরা অনেক প্রত্যাশা নিয়ে বই লিখতেন। উদ্দেশ্য ছিল পরিচিতি, সম্মান ও শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উপার্জনের একটা অবলম্বন সৃষ্টি। প্রকাশকদের কাছ থেকে যাই হোক একটা সম্মানী পেতেন বই বিক্রির কমিশন থেকে। কেউ কেউ নিজের লেখা বই বিক্রি করতেন পরিচিত জন, শুভাকাঙ্ক্ষী অথবা বই স্টল বা দোকান মালিকদের কাছে। লেখক কবিদের মনে অন্তত এইটুকু আশা ছিল, বই বিক্রি করে কিছু সম্মানী পাওয়া যাবে।
আজ সে স্বপ্নও যেন ভুল বানানের মতো কম্পিউটারের ডিলেট বাটনে অদৃশ্য হয়ে গেছে এক প্রেসেই। মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেটের যুগে বই পড়ে নষ্ট করার মতো সময় আছে আর ক’জনার। কেউ কেউ অবশ্য কোনো অনুষ্ঠানে কাউকে উপহার দেওয়ার বেলায় সস্তায় দাও মারতে বই রাখেন উপহারের তালিকায়। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে এই সুন্দর উদ্যোগ, সেই উপহার প্রাপ্ত ব্যক্তিটি কি কখনো পড়ে দেখেন এসব বইয়ে কী আছে? শুধু স্তূপীকৃত করে রেখে দেন ঘরের এক কোণে, অথবা বিক্রি করে দেন পেপারের দামে।
ইদানীং সমাদর না থাকলেও বইয়ের মুদ্রণজনিত খরচ বেড়ে গিয়ে একেবারে যে মগডালে ঠেকেছে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মোটামুটি মানের একটা মিডিয়াম পেজের বই ছাপতে কম করে হলেও এখন ৩০-৪০ হাজার টাকা প্রয়োজন। কম্পোজ খরচ, প্রচ্ছদ খরচ, পরিবহন খরচ তো আছেই। মানসম্মত বই ছাপা তাই অনেকের সাধ ও সাধ্যের বাইরে। সময়ের বিবর্তনে বইয়ের ধরনও পাল্টেছে তাই। একসঙ্গে কয়েকজন মিলে প্রকাশ করছে যৌথ গ্রন্থ। আবার একজনের সম্পাদনায় অনেক লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে কাব্য অথবা গল্প। তবে যেভাবেই প্রকাশিত হোক না কেন প্রকাশের পরে বই নিয়ে বাধে আরেক মহাঝামেলা। বস্তাবন্দি বই রাখার জায়গার বড় অভাব। বিশেষ করে যারা ভাড়া বাড়িতে থাকেন।
চাকরির বদলির সূত্রে বই টানা-হেঁচড়ার সমস্যাও অনেককে পোহাতে হয়। রক্ত জল করা পয়সায় ছাপা বই কাউকে কেনার কথা বললে, অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নেন। বলেন এখন থাক, রেখে দেন, পরে দেখব। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বিকেলে চায়ের আডডায় বসলে ২০-৫০ টাকা অনেকেরই ব্যয় হয়ে যায়। ব্যালেন্স রিচার্জ, ডাটা ক্রয়ে কত টাকা উবে যায়, কিন্তু ১০ টাকার একটা বই কেনার কথা বললে মনে হয় লেখকরা যেন সবার গলগ্রহ এক প্রাণী। কবিতার ভাষায় বলতে হয়, ‘এখন তো আর বই কেনেনা বৃদ্ধ কিম্বা ছেলে, ফ্রি দিলে নেবে হয়তো পড়বে না কেউ খুলে।’
চা, সিগারেট গলাধঃকরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার ফল শেষ, বরং এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক, কিন্তু ১০ টাকার একটি বই হতে পারে সারা জীবনের উপকারী বন্ধু। তার পরও বই কেনার ও পড়ার প্রতি এত অবজ্ঞা। এতদিন সভ্যতার ছন্দময় পথে আলো ছড়ালো যে সৃজনশীল বই তার আবেদন ফুরিয়ে যাক-এটা কারোই কাম্য নয়। যেভাবেই হোক বই পাঠের অভ্যাস আমাদের জাগিয়ে রাখতেই হবে।
জাগিয়ে রাখার আহ্বান জানানোর পেছনে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকার কথা নয়। পৃথিবীর অনেকে অনেক রকম নেশায় আকৃষ্ট। যার একটির নাম বই পড়া। নেশার দ্রব্যগুণও কম নয়। একেক নেশার ধরন একেক রকম। তবে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগে ধ্বংস, বিপরীতে সৃষ্টি। বই পড়ার নেশায় একবার যে পড়েছে তাকে খারাপ কাজে লিপ্ত হতে দেখার সম্ভাবনা খুবই কম। সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেই তার ভালো লাগা-ভালোবাসা।
পৃথিবীতে যদি বন্ধু হিসেবে কাউকে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে বোধহয় বই এর কোনো বিকল্প খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেননা, বই এমনই এক বন্ধু যে কারো অপকার করেছে-এমন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া ভার। সারাজীবন যে কেবল দিয়েই গিয়েছে বিনিময়ে নিল না কিছুই। সুতরাং এমন বন্ধুকে কি ফেলে দেওয়া যায়!
লেখক : কলামিস্ট
পিডিএসও/তাজ