শরীফ সাথী

  ১৪ অক্টোবর, ২০১৭

শোভা ও মেঘার গল্প

কোমরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নদীর কলকল স্রোত সামনে দিয়ে অবিরাম চলছে। তীরে আম্রকাননে শীতল ছায়া শিশু-কিশোরের মায়ায় জড়াচ্ছে। প্রশস্ত খেলার মাঠে সবুজ ঘাসের পালক ঢেকে রেখেছে কোমল মাটি। পূর্ব দিকের পাকা রাস্তা ব্রিজ অতিক্রম করে চলেছে মানুষের সেবা দানে। মধুময় সকাল সূর্যের আলোতে সাজিয়েছে প্রকৃতির নিদারুণ ছোঁয়ায়।

দল বেঁধে হই-হুল্লোড় করতে করতে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবাধে আগমন ঘটছে কচি কচি শিশুদের। মায়াভরা হাস্যোজ্বল মুখে পাকা রাস্তা ঘেঁষে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী শোভা স্কুলে যাচ্ছে। হঠাৎ প্রচন্ড বেগে ধেয়ে আসছে শ্যালো-ইঞ্জিনচালিত তিন চাকার ভটভটি আলগামন আলমসাধু। শোভার সমবয়সী একটি মেয়ে দ্রুত রাস্তা পার হচ্ছে। আলগামনে পিষ্ট হওয়ার আগেই শোভা তড়িৎ হাত ধরে মেয়েটিকে টেনে ফেলে দিল রাস্তার এক পাশে। শোভা বলল, এই কোথায় যাছে এভাবে? এক্ষুনি সর্বনাশ হয়ে যেত। মেয়েটি খুব ভয় পেয়ে গেল। হাঁফাতে হাঁফাতে আমতা আমতা করে বলল, দোকান থেকে পাউরুটি কিনে নিয়ে ফিরছিলাম। শোভা বলল, তুমি ওভাবে আনমনে হয়ে ফিরছিলে কেন? এখনই তো বিরাট একটি অঘটন ঘটত। হতেও তো পারত ভয়ানক দুর্ঘটনা? তাছাড়া তোমাকে আগে তো কখনো এখানে দেখিনি? মেয়েটি বলল, আমি এই এলাকার না? ওই যে আম বাগানের ছায়ায় পলিথিন তিরপল দিয়ে ছাওয়া ছোট্ট টংঘরে আমরা আছি। আমরা বাস্তুহারা, কেউ কেউ আমাদের বলে বেদে। একেক এলাকায় গিয়ে আমরা এভাবেই বসবাস করে থাকি। এক-দুই মাস থেকে আবার অন্যত্র চলে যাই। শোভা মেয়েটিকে ভালোভাবে দেখে নিল। মেয়েটির পরনে তালি দেওয়া প্যান্ট, সারা গায়ে অনায়াসে কাদা মাটি যেন সাদামাটাভাবে খেলা করছে। কোঁকড়া চুলগুলো আওলা-ঝাওলা মাথার চারদিকে। শোভা বলল, এই তোমার নাম কী? মেয়েটি ত্বরিৎ উত্তর দিল- মেঘা। সুন্দর নাম তো। চল মেঘা, নদীতীরের ওই আম গাছের ছায়ায় বসে কথা বলি। রাস্তা পাকা হোক আর কাঁচা হোক কখনো আর এভাবে দৌড়ে রাস্তা পার হবে না। ভালো করে ডানে-বামে নজর দিয়ে রাস্তা পার হবে। মেঘা বলল, তোমাদের স্কুলের ম্যাডাম বুঝি এভাবে চারদিকে দেখে রাস্তা পার হতে শিখিয়েছে? শোভা বলল- হ্যাঁ। আমার আব্বু আর আম্মুও বারবার সতর্ক হয়ে পথে চলার কথা বলে। কেন মেঘা? তোমার ম্যাডাম, বাবা-মা কিছু শিখায় না তোমাকে?

-আমি তো স্কুলেই যাই না? আমি তো পড়ালেখা করি না। আর আমার বাবা কখনো গাঁয়ে সাপ ধরতে যায়, আবার কখনো যায় বানর খেলা দেখাতে, আবার কোনো কোনো দিন নদীতে পুকুরে হারানো সোনার গয়না খুঁজতে যায়। আমার মা সকালে বের হয়ে সন্ধ্যায় এক পোটলা চাল নিয়ে ঘরে ফেরে। মেঘার কাথা শুনে শোভার প্রচন্ড মায়া হলো।

এক সময় শোভা ঘরে ফিরে আসে। তার মনে পড়ে মেঘার কথা। সে মনে মনে ভাবে, মানুষের জীবন এত কষ্টের হতে পারে? আমি বাবা-মায়ের কত আদরে-সোহাগে বড় হচ্ছি। নানান রকম আবদার আর হরেক রকম বায়নায় বিলাসী জীবন আমার। আর মেঘা? সে তো তার মা-বাবার সঙ্গে বড় হচ্ছে। কিন্তু কত পার্থক্য আমাদের দু’জনের মধ্যে। আমার মতো এত সুযোগ-সুবিধা ওর (মেঘার) নেই। ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত্রে শোভার দু’চোখে ঘুম এসে গেছে, সকালে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ কানের কাছে বাজতে থাকে। ঘুম থেকে উঠে শোভা তার আম্মুকে বলল, আম্মু আজ তুমি টিফিন বেঁধে দাও, আজ দুপুরে টিফিনে বাসায় আসব না, স্কুলে খাব? শোভার আবদার কি তার মা না শুনে পারে। মেয়ে লেখাপড়ায় খুব ভালো। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। শোভা টিফিন বাটি হাতে, বই-ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে গেল। ঠিক টিফিনের বিরতির ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে নদীর তীরে আম গাছের ছায়ায় মায়াবী মমতামাখা পরিবেশে এসে বসে সে। শোভাকে আম গাছের ছায়ায় বসা দেখে এগিয়ে আসে মেঘা। ফ্যাল ফ্যাল করে শোভার দিকে তাকিয়ে থাকে। শোভা মুচকি হেসে মেঘাকে কাছে ডাকে- মেঘা এখানে এসো। বস আমার পাশে। আস্তে আস্তে মেঘা শোভার পাশে গিয়ে বসে। শোভা বলল-দুপুরে কী খাও মেঘা? মেঘা কোমর থেকে দুই টাকা বের করে শোভাকে দেখিয়ে বলল, একটি পাউরুটি কিনে খাই। দুপুরে কেউ (বাবা-মা) থাকে না তো তাই? শোভা বলল-আজ থেকে তুমি প্রতিদিন টিফিনে আমার সঙ্গে খাবে? মেঘা বলল-তা হয় না। তোমার ম্যাডাম বকবে। তোমার সহপাঠীরা হাসাহাসি করবে? শোভা বলল, যাও হাতমুখ ধুয়ে এসো। কাল থেকে এভাবে আর নোংরা হয়ে থাকবে না। দুপুরে গোসল সেরে, হাত-মুখ পরিষ্কার করে থাকবে। আমার অনেক ভালো ভালো পুরানো জামা আছে, কাল তোমার জন্য নিয়ে আসব। ভয়ে ভয়ে মেঘা বলল, ঠিক আছে। কিন্তু তোমার আব্বু ও আম্মু তোমাকে যদি বকা দেয়, আমাকে জামা দিলে? আমি বলব, জামাগুলো আমার বান্ধবীর জন্য নিয়ে যাচ্ছি, তাহলে আর কিছু বলবে না। মেঘা বলল, তুমি খুব ভালো। এভাবে দিন সপ্তাহ যেতে থাকে। দু’জনের বন্ধুত্বের গভীরতা বাড়তে থাকে। দু’জনে খুব আনন্দ করে। শিশুদের কানামাছি, লাফালাফি, লাটিম ঘোরানো, কপাল টিপাটিপ কত রকম খেলা মনের আনন্দে দু’জনে দেখে। কিছু কিছু সময় শোভা মেঘাকে অ, আ, ক, খ পড়া শেখাতে থাকে। পুতুল খেলার মেলা বসায় ওরা দু’জন প্রতিদিনই বিকেলে।

মেঘা এক বিকেলে রাতের স্বপ্নের কথা শোভাকে শোনায়। সে বলে, শোভা আমি গত রাতে স্বপ্নে পরিদের সঙ্গে মেঘের ভেলায় চড়ে আকাশে উড়ে যেতে দেখেছি। শুধু উড়ছি আর উড়ছি, দেখছি নিচে সবুজ সবুজ ঘাস, লতাপাতা গাছ, নদীতে মাছের খেলা, নৌকা বেয়ে মাঝির ছুটে চলা, পাখিদের গান গাওয়া। ফুলে ফলে সাজানো এই পৃথিবীর কত কিছু? খুব ভালো লাগছিল জানো শোভা, খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু আবার খুব খারাপও লাগছিল।

-কেন মেঘা?

-তুমি সঙ্গে ছিলে না তো তাই।

-এইতো এখন তো আছি। নাও বাদামগুলো ঠুসঠাস করে করে ফাটিয়ে কে কত জোরসে খেতে পারে।

আজ খুব ভোরে শোভা ঘুম থেকে উঠেছে। হাত মুখ ধুয়ে নিজের ব্যাগে নতুন একটি বই, খাতা-কলম ভরে নেয় মেঘাকে দেবে বলে। সকালে লেখাপড়া শেষে নাশতা সেরে টিফিন হাতে নিয়ে আনন্দে যেতে থাকে স্কুলে। এগুলো মেঘাকে দেবে। লেখাপড়ার প্রতি তাকে আরো আগ্রহী করতে হবে। মনের ভেতর ছটফট করছে। কখন এগুলো মেঘাকে দেবে কখন দেবে। বাগানের পথ ধরে যেতে যেতে মেঘাদের টংঘরের দিকে তাকায়। শুধু ফাঁকা আর ফাঁকা। শোভা জোরে দৌড়ে গেল। ঘর গেল কোথায়? ডানেবায়ে তাকালে চোখে পড়ে আলমসাধুর ওপর সাজানো বাঁশ তিরপল। মেঘাদের সব টুকরো টুকরো আসবাবপত্র। শোভাকে দেখে মেঘা দৌড়ে কাছে এলো। বলল, শোভা আমরা চলে যাচ্ছি? দূর শহরের কোনো এক বাগান মাঠে? শোভার চোখের কোণে জল গড়াতে লাগল। দুজনে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদল। ব্যাগ থেকে বই-খাতা-কলম বের করে শোভা বলল, তুমি লেখা শিখবে, পড়া শিখবে। আর মনে মনে ভাবলো, গতকালের স্বপ্নের মতোই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ মেঘা। মেঘা বিদায় নিয়ে চলে গেল ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে। ছোট্ট শোভার হৃদয়ের স্পন্দন ব্যথায় কাতরাতে থাকে আর চোখের টলটলে জল গড়িয়ে পড়ে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গল্প
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist