ইউনুস আহমেদ

  ০৪ আগস্ট, ২০১৭

গল্প

তৃষ্ণার হলুদ বসন্তে

সামিনাকে দেখে চমকে উঠল রিশাদ। একেবারে ভূত দেখার মতো। এত বছর পরে! যেন বিশ^সাই করতে পারছে না। সামিনাও ওর দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন। হাতিরঝিলের এখানটায় ঘুরতে এসেছিল রিশাদ। মনটা ভালো লাগছিল না। একঘেঁয়েমিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল সে। সামিনার সাথে কত বছর পরে দেখা! এরপর ফ্ল্যাশব্যাক। দশ বছর অতীতে। কলেজের প্রথম দিনটিতেই ফিরে গেল রিশাদ। এই সামিনাই কলেজের প্রথম দিনই মন কেড়েছিল রিশাদের। কিন্তু রিশাদ তো একটা মুখচোরা ছেলে। বেশিদূর এগোতে পারেনি। সামান্য কথাবার্তা বলা, হাই হ্যালো- এই পর্যন্ত। রিশাদ খুব মেধাবী ছেলে। একেবারে অজপাড়াগাঁ থেকে এসেছে এই মফস্বলের কলেজে পড়তে। নি¤œবিত্তের ছেলেমেয়েরা সাধারণত সংগ্রামী হয়। রিশাদও তাই। স্বপ্ন ছিল আরো বড় কলেজে পড়ার, কিন্তু সাধ্য ছিল না। তাই এই কলেজে ভর্তি হয়ে সন্তুষ্ট হতে হয়েছে। ভেতরে যতটুকু অপূর্ণতা ছিল সেটুকুও কেটে গিয়েছিল সামিনাকে দেখে। সামিনা যে খুব একটা দেখতে সুন্দরী ছিল তাও নয়। আসলে ওর চেহারাটা বেশ আকর্ষণীয়। হাসিটা অনেক সুন্দর। যথেষ্ট বিনয়ী এবং ভদ্র। মাঝে মাঝে ওদের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা চলত। বেশিরভাগ সময়েই পড়ালেখা নিয়ে। সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট নিয়ে রিশাদ এই কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তাই সে শিক্ষকদের সুনজরে থাকত সব সময়। সামিনাও যে একেবারে ফেলনা ছিল তা নয়। বেশ মেধাবী। কথা কম বলত। খুব মিষ্টি করে হাসত। কিন্তু বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ওর আরেকটা বড় পরিচয় পাওয়া গেল। তাতে রিশাদ বেশ অবাক হয়েছিল। সামিনা ছিল ওর প্রতিদ্বন্দ্বী দলের লিডার। চুপচাপ শান্ত সামিনার এক ভিন্ন রূপ দেখেছিল রিশাদ সেদিন। প্রতিপক্ষকে ভয়ানকভাবে কথার বানে ক্ষতবিক্ষত করেছিল সামিনা। একটির পর একটি যুক্তির তীর ছুড়ে যাচ্ছিল একেবারে ঝানু তীরন্দাজের মতো। যুক্তিতর্কের মধুর উষ্ণতায় উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছিল কলেজ অডিটোরিয়ামের পরিবেশ। অকাট্য যুক্তি তর্কের বানে ভেসে গিয়েছিল রিশাদের জয়ের স্বপ্ন। পরাজয়ে মন খারাপ হয়েছিল রিশাদের। সেও তর্কে একেবারে কম যায় না। স্কুলে পড়ার সময় বিতর্কে ওকে কেউ হারাতে পারেনি। ধারে কাছেও কেউ আসতে পারতো না। সেই রিশাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল সামিনার দিকে। নতুন এক সামিনাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল রিশাদ। যেন অন্য এক সামিনা। সেই ঘটনার পর থেকেই সামিনাকে নিয়ে মনের মাঝে অন্য এক স্বপ্নের বীজ বুনতে থাকে রিশাদ। যে স্বপ্নের কথা সামিনাকেও জানতে দেয়নি বহুদিন। নিজের বুকের ভেতর লালন করেছিল অনেক দিন। সামিনা যখন জানতে পারে, তখন ওরা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে। রিশাদের স্বপ্নের কথা শুনে খুব একটা অবাক হয়নি সে। মুখ ফোটে সে কথা অকপটে রিশাদকে বলেছিল। কারণ সে স্বপ্ন সে নিজেও রিশাদকে নিয়ে দেখতে শুরু করেছিল সেই ঘটনার পর থেকেই, কিন্তু রিশাদকে তা জানতে দেয়নি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে। ‘কেন আগে বলনি?’ রিশাদ জানতে চাইলে সামিনা জানায়, মেয়েরা কী এসব কথা আগে মুখ ফোটে বলে। এরপর ওদের স্বপ্নের যুগল পঙ্খিরাজ বাধাহীন মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে থাকে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। সময় যে কত দ্রুত ফুরিয়ে এলো তা ওরা কেউই টের পায়নি। যখন টের পেল টেস্ট পরীক্ষা তখন একেবারে নাকের ডগায়। বাধ্য হয়ে পঙ্খিরাজের লাগাম টেনে ধরতে হলো। টেস্ট পরীক্ষা তখন শেষের দিকে। এক দিন পরীক্ষা শেষে কলেজ মাঠের শেষ প্রান্তে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ওদের কথা হয়েছিল। কৃষ্ণচূড়ায় ফুলের সমারোহ যখন বসন্তকে নিমন্ত্রণ করছিল। সামিনা জানাল, ওর বিয়ের কথা চলছে বাড়িতে। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের ছেলে। বিদেশ থাকে। দক্ষিণ কোরিয়া। বিয়ের পর আবার চলে যাবে। রিশাদকে দ্রুত করণীয় জানাতে বলে সামিনা। রিশাদ এ কথায় একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ যেন সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে। মুখ থেকে কথা সরে না রিশাদের। কী বলবে সে? বলার মতো কিছু আছে কি তার? কেবল ওর জনম দুখিনী মায়ের মুখটা ওর সামনে তখন ভেসে ওঠে। বোঝার বয়স হবার পর থেকেই এ পর্যন্ত মায়ের কষ্ট দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। মায়ের কষ্ট দূর করে তার মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই রিশাদের এত পরিশ্রম এত সংগ্রাম। সামিনাকে নিয়ে এখনই এসব স্বপ্ন দেখতে শুরু করেনি। কলেজ শেষ করে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। পড়া শেষ করে একটা কিছু করবে, তারপর না হয়ে চূড়ান্ত পরিণতির চেষ্টা। হঠাৎ যেন কালবৈশাখী শুরু হয়ে গেল রিশাদের মন জুড়ে। রিশাদ যেন দূর থেকে বিষাদের অশনি সংকেত শুনতে পায়। রিশাদ সব কথা খুলে বলতে পারে না সামিনাকে। সামিনা আহত হয় রিশাদের এই নীরবতায়। সময় গড়াতে থাকে। এক সময় এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয় রিশাদের। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিক্সে ভর্তিও হয়। ভার্সিটি পাস করে এক সময় সরকারি একটা ব্যাংকেও চাকরি হয় রিশাদের। এর মধ্যে সে অনেক খুঁজেছে সামিনাকে। ওর কাছে ক্ষমা চাইতে পারলে নিজেকে একটু হালকা ভাবতে পারত রিশাদ। আজ এমনিভাবে হঠাৎ সামনে পড়ে যাবে তা ভাবতে পারেনি রিশাদ।

‘কেমন আছ সামিনা?’ কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে রিশাদ।

‘ভালো’-সামিনার গলায় আগের মতোই স্বাভাবিকতা।

‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী সামিনা। আমাকে মাফ করে দিও।’ এ যেন রিশাদের শর্তহীন সমর্পণ।

‘তোমার ক্ষমা চাওয়ার কী আছে?’-সামিনা কথার পিঠে কথা বলে। ‘তোমার চাওয়াকে আমি সম্মান করতে পারিনি, তাই। আশা করি আমি ক্ষমা পাব।’ রিশাদ উত্তর দেয়। সামিনা কিছু বলে না। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ রিশাদের দিকে ফেরে সে, ‘কী করছো এখন?’

‘একটি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করছি’-রিশাদ জবাব দেয়।

‘বিয়ে শাদি কী...’ বলতে গিয়ে থেমে যায় সামিনা।

‘এখনো করিনি।’ সামিনার অসমাপ্ত প্রশ্নের উত্তর দেয় রিশাদ। এরপর ওদের কথা থেমে যায়। অঘোষিত নীরবতা ভিড় করে সেখানে।

মাম্মি, মাম্মি-হঠাৎ বাচ্চা মেয়ের চিৎকারে ওদের নীরবতায় আঘাত হানে। রিশাদ সামনে তাকায়। ফুটফুটে ছোট্ট এক মেয়ে লাল রঙের ফ্রক পরা- দৌড়ে এসে সামিনার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ‘আমার ছোট মেয়ে। কিছুতেই ঘরে থাকতে চায় না। তাই বেড়াতে নিয়ে এসেছি।’ রিশাদ এগিয়ে এসে আদর করে ওর নাম জিজ্ঞাসা করল। সামিনা

বলল, ‘ওর নাম জয়িতা।’

এদিকে কথায় কথায় কখন যে সন্ধ্যা হয়ে এলো তা যেন হঠাৎই খেয়াল হলো। ‘আজ যাই’, ‘বিয়ে থা করে সংসারী হও।’ সামিনা বলল। রিশাদ কিছু বলল না। কী বলবে সে? শুধু সামিনার গমন পথের দিকে চেয়ে রইল।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist