reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৮ জুলাই, ২০১৭

গল্প

বাবার কলম কোথায়

রিহাব মাহমুদ

বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে রামিশাহ। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার। সামনে যা কিছু ঘটছে তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। বুকের ভেতর কেউ যেন অনবরত হাতুড়ি পেটাচ্ছে। যার প্রতিটি আঘাত রামিশাহর হৃদয়টাকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। জীবনে এমন মুহূর্ত আসতে পারে তা যেন কল্পনারও অতীত।

আঠারো বছরের একজন তরুণীর পক্ষে এমন দৃশ্য সহ্য করা কষ্টের। চোখের সামনে যা কিছু হচ্ছে তার চেয়ে বড় অন্যায় আর কিছু হতে পারে না।

মায়ের সঙ্গে দাদুবাড়ি বেড়াতে এসেছে দুদিন হলো। কক্সবাজার জেলার কালিরছড়া নামক গ্রামটি ছোটখাটো হলেও শিক্ষিত লোকের সংখ্যা মোটেও কম নয়। রামিশাহর দাদুবাড়িটা এই অঞ্চলে জমিদারবাড়ি নামেই পরিচিত। বাড়ির সবচেয়ে পুরনো কাজের লোক বানুর সঙ্গে ঘুরতে বেড়িয়েছিল সে। জ্যৈষ্ঠ মাসের তীব্র রোদে ত্বক নষ্ট হতে পারে মায়ের এমন বারণ সত্ত্বেও বানু খালাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রাম দেখতে বের হয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি সে।

দাদুবাড়ি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ের পাশে হলেও পেছন দিকে পাহাড়ি অঞ্চলে বেশ কিছু নিরক্ষর লোকের বসবাস। বানু খালার বাড়িটাও এখানেই। মূলত বানুর বাড়ি দেখবে এই উদ্দেশ্যে এদিকে আসা। কিন্তু তার আগে মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাউনির একটি বাড়ি ঘিরে উৎসবের আমেজ দেখে কৌতূহলী রামিশাহ বানুর সঙ্গে বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করে। বানু খালার কাছে জানতে পারল এখানে বিয়ে হচ্ছে। গ্রামের বিয়ে সরাসরি দেখার লোভটাও রামিশাহ সামলাতে পারেনি। কিন্তু যার বিয়ে হচ্ছে তাকে দেখেই রামিশাহ কিংকর্তব্যবিমূঢ। বড়জোর ১১ বছর হবে মেয়েটার বয়স। স্বাস্থ্য ভালো। কি জানি আরো কম হতে পারে। মেয়েটার অমতে যে বিয়েটা হচ্ছে তা প্রথম দর্শনেই বুঝে গেছে রামিশাহ।

একজন কালোমতো চিকনা মহিলা সম্ভবত মেয়ের মা। জোর করে বাচ্চা মেয়েটাকে বিয়ের শাড়ি পরাবার চেষ্টা করছে। এই কাজে সে মেয়ের কাছ থেকে বাধা পাচ্ছে, তাই বারকয়েক গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করছে না।

উপস্থিত কেউ এর প্রতিবাদ করছে না। সবাই দেখে মজা পাচ্ছে। যেন ভয়াবহ এক বাল্যবিয়ের প্রস্তুতি। রামিশাহর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা থাকলে এর প্রতিবাদ করতেন। রামিশাহর বাবা ছিলেন একজন সাংবাদিক। এ রকম বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বাবার কলম সৈনিকের মতো কাজ করত। মায়ের মুখে শুনেছে, শুধু বাল্যবিবাহ নয়; অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বাবা সব সময় কলম ধরতেন। বাবার লেখা অসংখ্য প্রতিবেদন রামিশাহ পড়েছে, যা এখনো মায়ের সংগ্রহে আছে।

আজ বাবা নেই। সেই কলমও আর জেগে ওঠে না। তাতে কী হয়েছে। একসময় বাবার কলম যে উত্তাপ ছড়িয়েছিল তা এখনো লক্ষ মানুষের হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে। দিন পরির্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন-মানসিকতার পরিবর্তন যে হয়নি তা নয়। তার পরও কিছু কিছু জায়গায় এখনো স্বার্থলোভী কিছু মানুষ এমন হীন কাজে জড়িয়ে পড়ছে। কেউ অতি মুর্খতার কারণে আর কেউ কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মেয়েদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ডিজিটাল যুগে যা কারো কাম্য হতে পারে না।

রামিশাহ নিজেকে শক্ত করে। সে তো তার বাবার মেয়ে। বাবার আদর্শ ধারণ করেই বড় হচ্ছে। রুখতে হবে। যেভাবেই হোক। এমন ফুলের মতো একটা মেয়ের জীবন সে চোখের সামনে নষ্ট হতে দেবে না। একটু পরেই বরপক্ষের লোকজন চলে আসবে। চলে আসবে কাজি। তার আগেই যা করার করতে হবে।

রামিশাহ এগিয়ে যায়। কোনো ভণিতা না করে সরাসরি মেয়ের মাকে বলে-দেখুন আপনারা যা করছেন তা কিন্তু অন্যায়। আঠারো বছরের নিচে একটা মেয়েকে বিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। আপনার মেয়ের বয়স অনেক কম। বোঝার চেষ্টা করুন। এই বয়সে বিয়ে দিলে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। ও এখনো শিশু। এখনো সাবালিকা হয়নি। আপনারা জেনেশুনে কেন মেয়ের সর্বনাশ করছেন।

একটানা কথাগুলো বলে যায় রামিশাহ। উপস্থিত সবাই এতক্ষণ হা হয়ে তার কথাগুলো গিলেছে। মেয়ের মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আঞ্চলিক ভাষায় যে কথাগুলো বলে গেল তার সবটা না বুঝলেও বানু খালা তাকে বুঝিয়ে দিল। যার অর্থ দাঁড়ায়-ওরা গরিব মানুষ। ঠিকমতো তিনবেলা খেতে পারে না। সংসারে চারটা বাচ্চা। তাদের মানুষ করার সামর্থ্য পরিবারের নেই। যে ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে সে অনেক পয়সার মালিক। সৌদি আরব থেকে পাঁচ বছর পর দেশে এসেছে। বিয়ে করে ছয় মাস পর আবার সৌদি চলে যাবে। তাছাড়া এই ছেলে মেয়ের পরিবারকে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। মেয়েকে বিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই।

এসব শুনে দমল না রামিশাহ। আরো অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল। শুধু মেয়ের মাকে নয়, আশপাশে যে কজন মহিলা আছে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেও কোনো ফল হলো না। কেউ তার কথায় সম্মতি দিল না। সবাই মনোযোগ দিয়ে তার কথা গিলেছে আর নিজেদের মধ্যে চাপা হাসি হেসেছে। একপর্যায়ে মেয়ের বাপ এসে একপ্রকার ক্ষেপে গেল। বানু খালার ওপর রাগ করল এই কারণে যে, সে রামিশাহকে এখানে নিয়ে এসেছে।

রামিশাহ তাদের এটাও বোঝাল এই মেয়েকে তারা খাওয়াতে না পারলে সে তাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে পড়াশোনা করাবে। এতেও ওর বাবা-মা কেউ রাজি হলো না। তাদের কথা ওরা মেয়েকে কারো বাড়িতে ঝিগিরি করাবে না।

অবস্থা বেগতিক দেখে বানু রামিশাহকে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। রামিশাহর কান্না পাচ্ছে। সে কেন কিছুই করতে পারছে না। এই মেয়েটাকে সে কিভাবে সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচাবে। বাবার কথা মনে পড়ল আবার। বাবা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা করত। কিন্তু এখন কী করতে পারে রামিশাহ?

তখনি মনে পড়ল বাবার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর কথা। যিনি রামিশাহকে নিজের মেয়ের মতো আদর করেন। এখন একটি পত্রিকার সম্পাদক। সঙ্গে মোবাইল ছিল। রামিশাহ উনাকে ফোন করে সব কিছু খুলে বলে সহযোগিতা চাইলেন। তার কথায় বাবার বন্ধু তাকে নিরাশ করল না। দ্রুত একটা ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে তাকে আশ্বস্ত করল।

তার ঠিক দশ মিনিট পর রামিশাহর নম্বরে কক্সবাজারের টিএনও ফোন করলেন। তিনি বিস্তারিত জেনে লোকেশন জেনে নিয়ে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে তিনি উপস্থিত হবেন।

তার এক ঘণ্টা পরে যা ঘটল তার জন্য কালিরছড়াবাসী রামিশাহকে বাহবা না দিয়ে পারল না। রামিশাহর জন্যই একটি মেয়ের জীবন রক্ষা পেল। টিএনও সাহেব পুলিশ নিয়ে নিজে উপস্থিত হয়ে বিয়ে ভেঙে দিলেন। তার আসার খবর শুনে আগেই কাজি পালিয়ে গেছে। তবে রামিশাহর বিশেষ অনুরোধে কাউকে গ্রেফতার করা হলো না। টিএনও সাহেবও সবাইকে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝিয়ে দিলেন। টিএনও রামিশাহকে ধন্যবাদ দিলেন এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।

এলাকাবাসী বাবার প্রশংসা করে রামিশাহকে বাহবা দিচ্ছে। সবাই বলাবলি করছেন, অমুকের মেয়ে। বাপের মতোই হয়েছে। আমাদের এলাকার গর্ব। রামিশাহর চোখ ভিজে উঠল। তার মনে হলো এই বুঝি বাবা তার পাশেই আছে। রামিশাহ বাবাকে সারাক্ষণ বুকে ধারণ করে। তাইতো সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাবা,কলম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist