বিশ্বজিত রায়

  ২৫ মে, ২০১৭

জন্মজয়ন্তী

অসাম্প্রদায়িক চেতনায় চিরভাস্বর নজরুল

যুগে যুগে পৃথিবীতে কিছু মানুষ এসেছেন প্রেরণার উৎস হয়ে। যারা স্ব-স্ব প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে এনেছেন আলোর সন্ধান, নিজেদের সৃষ্টি বা কর্ম দ্বারা গড়েছেন ইতিহাস। তেমন একজনকে নিয়েই আজকের আলোচনা। সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা এক দুখু মিয়া। যিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হন অভাব-অনটন আর দুঃখ-কষ্টের অন্ধকার কুঠিরের নিভু নিভু প্রদীপরূপে। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। বাবা-মায়ের দুঃখের সংসারে জন্ম হওয়ায় তাকে ডাকা হতো দুখু মিয়া নামে। সেই দুখু মিয়া একসময় আপন কর্মগুণে কবি খ্যাতি অর্জন করেন। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ সালের ২৫ মে) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল শহরস্থ চুরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা পিতা কাজী ফরিদ উদ্দিন ও মাতা জাহেদা খাতুনের সংসারে জন্ম প্রেম, দ্রোহ, মানবতা ও সাম্যের কবি বিদ্রোহী নজরুলের। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। এরপর থেকেই নজরুল আমাদের জাতীয় কবি।

আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৮তম জন্মবার্ষিকী। নজরুল শুধু একটি নামই নয়, বিপ্লবী জীবনের একটি সফল প্রতিচ্ছবি। অভাবী দুখু নিজেকে চালিত করতে অল্প বয়সেই নেমে পড়েন কর্মখোঁজে। লেটো দলের বাদক, রেল গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের শ্রমিক, সৈনিক কিংবা সাংবাদিকতা, কখনো আবার কাজ করছেন কলকাতা বেতারে। সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি নেমেছেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে কারারুদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু থামেনি প্রতিবাদী নজরুলের কলম। শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে জুলুমবাজ, অত্যাচারী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছে তার কাগজ-কালি।

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দুই বাংলাতেই তার কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তার কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। সকল অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তার কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তার প্রকাশ।

তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্য তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সংগীত বা নজরুল গীতি নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়।

জাত ভেদাভেদ ভুলে গেয়েছেন সাম্যের গান। সৃষ্টির সেরা মানব জাতিকে একই কাতারে মিলিত করতে ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় তিনি বলেছেন—

‘গাহি সাম্যের গান

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান

যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।’

আবার ‘মানুষ’ শিরোনামের অন্য একটি কবিতায় লিখেছেন—

‘গাহি সাম্যের গান

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!

নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,

সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’

মানবপ্রেমী নজরুল কর্মগুণে হয়েছেন মহীয়ান। তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন মানবতা ও সত্য-সুন্দরের পক্ষে। দুখু মিয়া খেটেখাওয়া মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গী হতে পেরেছেন। তাইতো তিনি ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় বলেছেন—‘দেখিনু সেদিন রেলে,/কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!/চোখ ফেটে এল জল, এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’ গরিব-দুখি, অসহায় মানুষদের প্রতি সমাজের বিত্তবানদের এমন আচরণ সইতে না পেরে কবি লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন বারবার।

জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ‘অভিশাপ’ নামক কবিতায় তিনি লিখেছিলেন—

‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে

অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে

বুঝবে সেদিন বুঝবে।

ছবি আমার বুকে বেঁধে

পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে

ফিরবে মরু কানন গিরি

সাগর আকাশ বাতাস চিরি

সেদিন আমায় খুঁজবে

বুঝবে সেদিন বুঝবে।’

অভিমানভরা মনে লেখা কথাগুলো নজরুল ভক্তদের হৃদয়ে আজও দাগ কাটে। মৃত্যুর মাঝে দেহ নিঃশেষ হলেও নজরুল যে হারিয়ে যাননি ওই কবিতাংশটুকু বহন করে চলেছে তার সত্যতা। গোধূলি লগনে মাথার ওপর মিটিমিটি তারাগুলোও যেন পৃথিবীর বুকে খুঁজে ফিরে কবির হারানো স্মৃতিগুলো। অশ্রুসিক্ত নয়নে পাহাড়-পর্বত, ধু-ধু ফাটল প্রান্তর, ফুলের বাগান, সমুদ্র-নদী কিংবা উড়ন্ত মেঘের বুক চিরে গগনপানে অপূর্ণ হৃদয়টি তন্ন তন্ন হয়ে খুঁজে ফিরছে নজরুলের অদৃশ্য চেহারাটি। হ্যাঁ বুঝেছি আমরা, সবাই বুঝেছি তোমার শূন্যতা।

১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা এলবার্ট হলে বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের পক্ষ থেকে সংবর্ধিত করা হয় কাজী নজরুল ইসলামকে। উক্ত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্যের একাংশে তিনি বলেছিলেন-‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। ওই অভিযান-সেনাদলের তূর্যবাদকদের একজন আমি। এটাই আমার বড় পরিচয়। যাঁরা আমার নামে অভিযোগ করেন তাঁদের অনুরোধ, আকাশের পাখিকে, বনের ফুলকে, গানের কবিকে তাঁরা যেন সকলের করে দেখেন। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই; আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’ নজরুলের প্রতি সম্মান রেখে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন- ‘ভাগ হয়ে গেছে বিলকুল/ভাগ হয়ে গেছে সব কিছু আজ/ভাগ হয়নিকো নজরুল।’ সত্যিই নজরুল সব কিছুর ঊর্ধ্বে। বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি ঝাঁকরা চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ। স্রষ্টা নিজ হস্তে ভিন্ন কোনো বস্তু দিয়ে গড়ে তুলেছেন বাঙালি এই দেহটি। নজরুল অতুলনীয়। তিনি ৭৭ বছরের জীবনে ৩৪ বছরই ছিলেন নির্বাক। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ২৪ বছরের সাহিত্যচর্চায় তিনি সৃষ্টি করে গেছেন ২২টি কাব্যগ্রন্থ, ৭ হাজার গানসহ ১৪টি সংগীত গ্রন্থ, ৩টি কাব্যানুবাদ ও ৩টি উপন্যাস গ্রন্থ, ৩টি নাটক, ৩টি গল্পগ্রন্থ, ৫টি প্রবন্ধ, ২টি কিশোর নাটিকা, ২টি কিশোর কাব্য, ৭টি চলচ্চিত্র কাহিনিসহ অসংখ্য কালজয়ী রচনা। তাই তো নজরুল একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, গীতিকার, সুরকার, স্বরলিপিকার, গীতিনাট্যকার, গীতালেখ্য রচয়িতা, চলচ্চিত্র কাহিনিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, সংগীত পরিচালক, গায়ক, বাদক, সংগীতজ্ঞ ও অভিনেতা। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমাদের প্রেম, ভালোবাসায় গড়া এক মহান পুরুষ, মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

লেখক : কলামিস্ট [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জন্মজয়ন্তী,কাজী নজরুল ইসলাম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist