জুয়েল কবির

  ১২ মে, ২০১৭

তরুণীর কঙ্কাল

: হ্যালো, কালাম ভাই?

: ভোরবেলা আয়া পড়েন ছোড ভাই। ডেড বডি এহন সিদ্ধ করতাছি, সকাল সকাল ডেলিভারি নিতে পারবেন।

: কী বলেন? কাঁচা কাঁচা থাকবে না তো?

: অল্প সময়ে শুকানোর ব্যবস্থাও আছে। আমি সব ঠিকঠাক কইরা রাখবো। টাকা-পয়সা একটু বাড়ায়া দিয়েন। অল্প বয়সী তরুণীর বডি জোগাড় করতে কষ্ট হইছে ম্যালা।

: সত্যি সত্যিই তরুণীর কঙ্কাল তো কালাম ভাই? আমি কিন্তু পেলভিস দেখলেই বুঝতে পারবো। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের পেলভিস ছোট আর গোলাকৃতির হয়।

: বিশ্বাস না অইলে নগদে আয়া পড়েন কারখানায়। এহনো বডি পুরাডা সিদ্ধ হয় নাই। নিজের চোখে দেইখা লন।

: না না, দেখতে হবে না। নারী-পুরুষের কঙ্কালের আর যেসব পার্থক্য থাকে, তাও আমি জানি।

: তাইলে আর কী, দেখলেই বুঝতে পারবেন।

: আমি সকাল সকালই আসবো তাহলে।

: ঠিক আছে।

আব্দুস সালেকীনের দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাস। ওঠারও অভ্যাস দেরিতে। কিন্তু এদিন তার ঘুম ভেঙে গেল আগেভাগে। সকাল সকাল মাল ডেলিভারি নেওয়ার টেনশনেই সম্ভবত এই প্রত্যুষ জাগরণ। শহরের কাকগুলোও হার মেনেছে আজ সালেকীনের কাছে। যখন সে উঠলো, তখন সবেমাত্র পার্শ্ববর্তী মসজিদের মুয়াজ্জিন ফজরের আযান দেবে বলে মাইক পরীক্ষা করছে। ফু...ফু...ফু...।

সালেকীন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে তার কাঁধের বড় ব্যাগটা নিয়ে বাইকে স্টার্ট দেয়। দারোয়ান বলেÑ

: এত সকাল সকাল কই যান স্যার?

: কঙ্কাল কিনতে।

: কঙ্কাল! কী কন? মাইনষের কঙ্কাল?

উত্তরের অপেক্ষায় হা করে থাকে দারোয়ান। সালেকীন বুঝতে পারে, ফজলু দারোয়ানের বিস্ময়ে হা হয়ে থাকা কমপক্ষে আগামী দশ মিনিট ধরে থাকবে। অবশ্য তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। ফজলু মিয়ার হা হয়ে থাকার সর্বোচ্চ রেকর্ড ঊনপঞ্চাশ মিনিট। সেদিন সকালবেলা তার এক ভাস্তে ফোন করলো গ্রাম থেকেÑ

: বিরাট বড় সুখবর কাকা, বিরাট সুখবর...

: কিয়ের সুখবর?

: তাই নাকি! বাচ্চা কেমন আছে?

: বাচ্চা না কাকা, বাচ্চা না, বলেন বাচ্চাগুলা।

: মানে?

: একলগে তিনটা নাতি হইছে আপনের। দুইডা পোলা, একটা মাইয়া। মা আর বাচ্চাগুলা সুস্থ আছে। মিষ্টি খাওয়ার টাকা পাঠান।

ফজলু মিয়া হা করে থাকে। মুখ আর বন্ধ হয় না। অবশ্য এমন সংবাদে সবাই অবাক হবে, সন্দেহ নেই। তবে ফজলু মিয়ার মতো হা করে হয়তো থাকবে না কেউ। একেকজন মানুষ একেকভাবে অনুভূতি প্রকাশ করে। কেউ বেশি কথা বলে, কেউ কম কথা বলে। ফজলু মিয়া অনুভূতি প্রকাশ করে হা করে। সময় চলে যায়, যেতেই থাকে, কিন্তু ফজলু মিয়ার হা করা মুখ আর বন্ধ হয় না। এক পর্যায়ে সবাই ভয় পেয়ে যায়, স্ট্রোক করেনি তো ফজলু মিয়া? অবশেষে সাতচল্লিশ মিনিট পর তার হা-মুখ বন্ধ হয়, চলন-বলন হয় স্বাভাবিক।

দারোয়ানের দরোজা খোলার অপেক্ষা না করে সালেকীন নিজেই কলাপসিবল গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে।

প্রত্যাশা সার্থক হয়েছে সালেকীনের। সত্যি সত্যিই একটা তরুণীর কঙ্কাল পাওয়া গেছে। অতিরিক্ত সতর্কতাস্বরূপ প্রমাণ হিসেবে ডেড বডি সিদ্ধ করার আগে কালাম ডোম তার মোবাইল ফোনসেটে একটা ছবি তুলে রেখেছিল। মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দর। গায়ের রং ফর্সা, কোঁকড়ানো চুল। ঠোঁটের কাছে একটা তিলও আছে। মাটির প্রতিমা যেমন হয়, মেয়েটি তেমনি নিখুঁত। সালেকীন লোভ সামলাতে পারে না। ব্লুটুথে করে ছবিটা নিজের মোবাইল ফোনসেটে নিয়ে নেয়।

: লাশটা কোথায় পাওয়া গেছে?

: লঞ্চডুবিতে। বেওয়ারিশ মাল।

: আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে দেন নাই যে।

: ওসব জিগায়েন না ছোড ভাই। সব লাশ ওইখানে দিয়া দিলে আপনেরা কঙ্কাল পাইবেন কই?

: তা ঠিক। আচ্ছা এবার বলেন, কত দিতে হবে কালাম ভাই?

: দাম নিয়া সমস্যা হইবো না ছোড ভাই, তাছাড়া দাম তো আপনে জানেনও। দিয়েন পাঁচ হাজার।

: কী বলেন! পাঁচ হাজার টাকা?

শুরু হয় দরাদরি। এ যেন যাত্রাবাড়ীর মাছবাজার। কালাম একটা দাম বলে, তো সালেকীন আরেকটা। শেষ পর্যন্ত দুই হাজার আটশো টাকায় বনিবনা হয়।

: এত সস্তায় এই রহম ফেরেশ মাল অন্য কোনো জায়গায় পাইবেন না।

: সস্তায় আর কই? সবাই তো দেহি দুই-আড়াই হাজার টাকায় কেনে। আমার বন্ধু সাকিব কিনছে আঠারোশ’ টাকায়।

: আরে ওইগুলা ডিফেক্ট মাল। অ্যাক্সিডেন্টের লাশে হাড়মাড় ভাঙ্গা থাকে। ওরা জোড়াতালি দিয়া বেচে ফেরেশ মালের দামে। তাছাড়া চাহিদামতো খাঁটি তরুণীর কঙ্কাল পাইবেন কই। বুড়ি বেডির কঙ্কাল ধরায়া দিবো জোয়ান ছেরির কঙ্কাল কয়া।

: সে আপনি ভালো বুঝবেন কালাম ভাই। আমি কি আর অত কিছু বুঝি নাকি।

: ছোড ভাই এহনো সময় আছে। পছন্দ না হইলে রাইখা যাইতে পারেন। ফেরেশ মাল কেনার লোকের অভাব হইবো না।

: আরে না না, কালাম ভাই। আমিই নেবো। দিন, ব্যাগে ভরে দিন।

কালাম ডোম সুন্দরভাবে ভাঁজ করে সালেকীনের ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয় পুরো কঙ্কালটি।

সালেকীনের বহুদিনের ইচ্ছা, যদি কঙ্কাল কেনে, তাহলে কোনো তরুণীর কঙ্কালই কিনবে। প্রত্যাশিত সেই তরুণীর কঙ্কাল আজ সালেকীনের পিঠে। পিঠে মানে পিঠের ব্যাগে। লোকে দেখবে, মোটরসাইকেল আরোহীর পিঠে একটা স্কুলব্যাগ। হয়তো কেউই বুঝবে না, ব্যাগের ভেতর মানবকঙ্কাল। আচ্ছা, রাস্তায় পুলিশ যদি ব্যাগ চেক করে। বোমা বহনকারী সন্দেহে চেক করতে গিয়ে যদি দেখে ফেলে সালেকীনের ব্যাগে মনুষ্য কঙ্কাল, তাহলে? ইদানীং বোমা হামলার আশঙ্কায় নজরদারি বেড়েছে পুলিশের। সালেকীনের ভয় লাগে। ব্যাগে কঙ্কাল পেলে কি ওর বিরুদ্ধে কোনো খুনের মামলা হবে? যদি দেখে ফেলে, তাহলে কি কঙ্কালের উৎস সন্ধানে কোনো তদন্ত কমিটি হবে? যদি বুঝে ফেলে তরুণীর কঙ্কাল, তাহলে কি রেইপিস্ট ভাববে তাকে? ভাবতে ভাবতে লাশঘর সংলগ্ন গলিপথ ধরে এগোয় সালেকীন। গলিপথটা দুর্গন্ধে ঠাসা। ভাঙাচুরা, এবড়োখেবড়ো। সালেকীন মোটরবাইকটা পর্যন্ত ঢোকাতে পারেনি। রেখে এসেছে গলির মাথায়। আশপাশে তাকিয়ে লোকজনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সালেকীন। বাইকের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ টের পায়, কঙ্কালটা যেন কথা বলে উঠলোÑ

: মোটরসাইকেল স্টার্ট দাও আব্দুস সালেকীন। খুব গরম লাগতাছে। বাইক ছাড়লে একটু বাতাস লাগবো গায়।

আব্দুস সালেকীনের গায়ে কাঁটা দেয়। তার ব্যাগে যে কঙ্কাল, সে আত্মাপরিত্যক্তা। দুই দিন আগে আত্মাটি চলে গেছে কঙ্কালটিকে অসহায় করে। আত্মাহীন কঙ্কালের কথা বলার কথা নয়। তবুও আব্দুস সালেকীন কঙ্কালের আদেশে তাড়িত হয়ে বাইকে স্টার্ট দেয়। বাইকের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুইশ’ ছয়টা হাড় একযোগে বাদ্যের ঝঙ্কার তোলে ব্যাগের ভেতর। সালেকীন হতচকিত হয়। পর মুহূর্তেই ভাবে, এ নিতান্তই তার ভীত মনের কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।

পথে কেউ আটকায় না সালেহীনকে। না পুলিশ, না অন্য কোনো মানুষ। বাসার দারোয়ানও জিজ্ঞেস কওে না কিছু। দারোয়ান হয়তো ভেবেছে, সালেকীন ভোরবেলা কঙ্কাল কেনার কথাটি তাকে ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিল। সুতরাং কঙ্কাল নিয়ে বাসায় ফিরতে কোনোই সমস্যা হয় না সালেকীনের। ঘরে ঢুকে সে কঙ্কালটা টাঙ্গায় তার পড়ার টেবিল সংলগ্ন দেওয়ালের ঠিক মাঝ বরাবর।

অবাক কাণ্ড! কঙ্কালটি যেন কথা বলে আবার। এবার আর রাখঢাক করে নয়, রীতিমতো ধমকায় সালেকীনকে।

: ছি ছি, কী নোংরা ঘরদোর! বিছানাপত্তর অগোছালো। কী ব্যাপার, কাপড়চোপড় কি ধোয়া হয় না? এত বিচ্ছিরি গন্ধ কেন? ওয়াক।

: কে? কে কথা বলে? কে?

: সে কি, আমি। আমি ফারজানা। আমাকে চিনতে পারছো না?

সালেকীন আশপাশে তাকায়। না, কেউ তো নেই। তাহলে কথা বলছে কে?

: আশপাশে তাকাচ্ছো কেন? সোজা তাকাও। আমি তোমার টেবিলের ওপর। এই যে এখানে।

সালেকীনের চোখ এবার স্থির হয় কঙ্কালের ওপর। সে শব্দের উৎস সন্ধান করত থাকে। কঙ্কাল বলেÑ

: আচ্ছা, আমাকে তুমি এভাবে ঝুলিয়ে রেখেছো কেন? তোমার কি দয়ামায়া নেই? আমার হাঁসফাঁস লাগছে। প্লিজ, আমাকে নামাও।

সালেকীন বুঝে উঠতে পারে না, কী করা উচিত। এবার সে নিশ্চিত হয়েছে, এই শব্দ আর কারো নয়, এই শব্দ কঙ্কালতরুণীর।

: কী ব্যাপার! কী এত ভাবছো? নামাবে না আমাকে?

: নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই নামাচ্ছি। নিশ্চয়ই।

সালেকীন ভেবে পায় না, সে কী করছে। টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কঙ্কালটিকে নামিয়ে রাখে টেবিলের ওপর। শুইয়ে দেয়। তারপর তাকিয়ে থাকে বোঝার জন্য। সে কি আসলে কঙ্কালের শব্দই শুনছে?

: এভাবে তাকিয়ে থেকো না। দেখছো না, আমার গায়ে কোনো জামা-কাপড় নেই। তুমি তো ভারি নির্লজ্জ মানুষ। ছি ছি, আমাকে অসহায় পেয়ে এভাবে দেখছো?

: না না না, আমি দেখছি তোমার মুখ-চোখ-নাক। আমি তোমার উলঙ্গ শরীর দেখছি না। প্লিজ, আমাকে এ ধরনের ব্লেম কোরো না। আমি সেরকম নই।

: আচ্ছা মানলাম, তুমি সেরকম নও। তবুও তোমার উচিত আমার শরীরটাকে কাপড়ে ঢেকে দেয়া। তোমার বয়স অল্প। আমারও। বলা তো যায় না, রাত-বিরাতে যদি তোমার অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্য জাগ্রত হয়। তাছাড়া আমারও তোমার সামনে খালি গায়ে শুয়ে থাকতে খুব অস্বস্তি লাগছে।

সালেকীন হঠাৎ পাগলের মতো ভাব করে। চোখ বন্ধ করে, মাথা ঝাঁকায়, আবার তাকায়।

: না না না, তুমি কঙ্কাল, তুমি জীবন্ত নও, কথা বলতে পারো না। না না না।

হঠাৎ দৌড়ে যায় বিছানার কাছে। বিছানার নিচ থেকে তার ট্রাংকটা বের করে আনে এক টানে। রুপালি রঙের ট্রাংক, বেশ পুরনো, সেটা বোঝা যায় ট্রাংকের তলা দেখেই। জং ধরে খসে যাওয়ার উপক্রম। ট্রাংকের ওপর কালো হরফে লেখাÑ মো. আব্দুস সালেকীন, গ্রাম-লাঙ্গলজোড়া, ডাকঘর-ঘোষগাঁও, উপজেলা-ধোবাউড়া, জেলা-ময়মনসিংহ। ট্রাংক খুলে একটা বিছানার চাদর বের করে কঙ্কালটাকে ঢেকে দিয়ে দ্রুত রুমের বাইরে বেরিয়ে আসে।

হাঁটতে থাকে সালেকীন। গলিপথ ছেড়ে রাজপথে। হাঁটে খুব দ্রুত পায়ে। যেন তাকে তাড়া করেছে কেউ। পেছনে ফিরেও তাকায় না আর। পেছনে পড়ে আছে মেস, মেস-মেম্বার সব। একটা ভুল বোধ হয় করা হয়ে গেছে। আসার সময় তাড়াহুড়ার ভেতর রুমের দরোজা না লাগিয়েই চলে এসেছে সে। যদিও সালেকীন জানে, তার রুমে অন্য কেউ প্রবেশ করবে না সহজে। কারণ, মেসের অন্যরা থাকে রুম শেয়ার করে। সালেকীনই একমাত্র সিঙ্গল থাকে। থাকে, কারণ, তার মেডিক্যালের পড়াশোনার চাপ একটু বেশি। রাত জেগে পড়তে হয় তাকে। লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হয়। রুম শেয়ার করলে তার কারণে রুমমেটের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। তাছাড়া রুমমেট থাকলে রুমে আড্ডা হয় বেশি। আর আড্ডা হলে পড়াশোনারও ডিস্টার্ব হয়। পড়ুয়া ছেলে সালেকীন অনেক ভেবেচিন্তে তাই রুমে থাকে একাই। এতে খরচ কিছুটা বেশি হয়। তা হোক, তার বাবা-মার একমাত্র ছেলে সে। বাবা-মার বিষয়সম্পত্তিও কম না। তারা বরং তাদের ছেলের পেছনে টাকা খরচ করতেই বেশি আনন্দ পায়। সুতরাং সমস্যা নেই। কিন্তু এভাবে একা থাকতে থাকতে সালেকীন কিছুটা অসামাজিক হয়ে গেছে। তার রুমে অন্য মেস-মেম্বারদের অ্যাক্সেস খুবই কম। তবে এই অসামাজিকতার সুবিধাটা আজ বোধ হয় পাওয়া যাবে। রুমের দরোজা খুলে উঁকি দেবে না কেউ। সুতরাং রুমটা নিরাপদেই থাকবে।

আচ্ছা, সালেকীন কি শুধু রুমের নিরাপত্তার কথাটাই ভাবছে, নাকি মেয়েটারও? সে কি কঙ্কাল-মেয়েটিকে ভয় পাচ্ছে? নাকি ভালোবেসে ফেলেছে? মোবাইল ফোনসেট খুলে ব্লুটুথে কালাম ডোমের কাছ থেকে নেয়া ছবিটা দেখে সালেকীন। মেয়েটির ঠোঁট দুটো খুব পাতলা, হালকা চিকন ভ্রু, নাক কিছুটা বোঁচা। চোখটা বন্ধ বলে ছোট, নাকি বড়, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

: এই বাদাম...বাদাম...বা-দা-ম।

পুঁচকে বাদামওয়ালা বাদাম বিক্রি করতে করতে লুকিয়ে কখন সালেকীনের মোবাইল ফোনসেটের স্ক্রিনে তাকিয়েছে, সালেকীন তা জানেই না। সম্বিত ফিরে পেয়ে সালেকীন দ্রুত আড়াল করে ছবিটা।

: ওইডা কি আপনের লাভারের ছবি স্যার?

সালেকীন পারলে যেন এক চটকনা মারে বেয়াদব ছেলেটাকে। বড়দের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয়, সেটাও শেখেনি।

: যা ফোট, বেশি পাকা, যা...

বাদামওয়ালা ছেলেটি চলে যেতে যেতে আবার পেছনে ফিরে তাকায়। তারপর ভেংচি কাটেÑ

: পাগল, পাগল, লোকটা প্রেমের পাগল...

বলতে বলতে দৌড়ায় বাদামওয়ালা ছেলেটি। সালেকীনের জেদ চাপে। কিন্তু বাদামওয়ালা ছোকরার পেছনে দৌড়াতে ইচ্ছা হয় না তার।

আব্দুস সালেকীন ভাবে, সে কি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেছে! নাকি যাচ্ছে? পাগল না হলে কঙ্কাল তার সঙ্গে কিভাবে কথা বলে, আর সে-ই বা কঙ্কালের কথা কিভাবে বুঝতে পারে? না, আর হ্যালোসিনেশনকে প্রশ্রয় দেবে না সে। আর নয়। সালেকীন এবার দেখতে চায়, কিভাবে কী হয়। এবার সে সত্যিই মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় সত্যিকার সত্যের।

দুপুরবেলা প্রেসক্লাবের পাশের রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানি খায় সালেকীন। এক প্যাকেট বিরিয়ানি সঙ্গে করে নিয়েও নেয় সে। মেসের খাবার খায় না সালেকীন। এমনিতেও বাইরে খায়। এক্সট্রা প্যাকেটটা নিয়ে নিল রাতে খাওয়ার জন্য। কাল একটা টিউটোরিয়াল পরীক্ষা আছে। পড়তে পড়তে বেরোনোর সময় না পেলে রুমেই খেয়ে নেবে রাতের খাবার। কয়েকটা মোমবাতিও নেয় সঙ্গে, যাতে কারেন্ট চলে গেলে তৎক্ষণাৎ জ্বালাতে পারে। তবে কি ভয় পাচ্ছে সালেকীন! অন্ধকারে কঙ্কালের ভয়? হতে পারে।

মেসে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। তার রুমের দরোজা যেমন ছিল, তেমনিই আছে। চাপানো। রুমে ঢুকেই সালেকীন দেখে, তার বিছানাপত্তর, কাপড়-চোপড় সব গোছানো। ফ্লোরটাও মনে হচ্ছে ধোয়ামোছা। রুমে ঢুকেই মনটা ভরে গেল সালেকীনের। কে করলো এসব?

: এলে তাহলে?

: হ্যাঁ এলাম।

এ কী! সালেকীন কার কথার উত্তর দিল? তাকিয়ে দেখে, কঙ্কালটা যথারীতি দেয়ালে টানানো। সে কী! ওকে আবার দেয়ালে টানালো কে?

: আমিই টানিয়েছি আমাকে। মনে হলো, আমাকে তোমার এভাবে দেখতেই ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, আমাকে ওপর থেকে নামানোর কথা বলাতেই যেন তুমি চলে গিয়েছিলে বাইরে।

: না, ঠিক তা নয়।

: মিথ্যা বলো না। আচ্ছা, কোথায় ছিলে সারাদিন? কী করলে একা একা?

: না মানে, কলেজে গিয়েছিলাম।

: ফের মিথ্যা বলছো। আজ শুক্রবার, কলেজ বন্ধ। তুমি অন্য কোথাও গিয়েছিলে। না বলতে চাইলে থাক।

: না মানে...

: আচ্ছা, খুব ক্ষুধা লেগেছে আমার। তোমার হাতে ওটা কী?

: বিরিয়ানির প্যাকেট। দুপুরে খেলাম, আর...

: আর আমার জন্য নিয়ে এসেছো। তাই না?

: হ্যাঁ, মানে তা-ই...।

: যাও। বাইরে থেকে এসেছো, হাতমুখ ধুয়ে নাও।

: নিশ্চয়ই।

আব্দুস সালেকীন লক্ষ্মী বালকের মতো টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে যায়। কড়া ভাষায় তার কিছুই বলা হয় না কঙ্কালটিকে। যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঘরে ফিরেছিল, সেসব কিছুই আর করা হয় না তার। আব্দুস সালেকীন হয়ে যায় এক কঙ্কাল নারীর একান্ত বাধ্যগত।

কঙ্কাল ফারজানাকে এখন আর ভয় লাগছে না সালেকীনের। সে তার জীবনের ইতিহাস জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

: আচ্ছা, তোমার নাম কি শুধুই ফারজানা?

: না, ফারজানা আক্তার আমার নাম। বাবা নজরুল ইসলাম কুসুমপুর হাইস্কুলের অঙ্ক শিক্ষক, মা নূরজাহান আক্তার পরিবার পরিকল্পনা অফিসে চাকরি করে। আপন আর কোনো ভাইবোন নেই।

: তুমি তাদের একমাত্র সন্তান?

: হ্যাঁ। একমাত্র। বেশি আদরের। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতো। ভীষণ আগলে রাখতে চাইতো আমাকে। আর তাদের এই প্রবণতার জন্যই আজকের এই পরিণতি আমার।

: কেন? এ কথা বলছো কেন?

: ছাত্র খারাপ ছিলাম না মোটেও। কিন্তু কী কারণে যেন আমার ফিজিক্স পরীক্ষাটা খারাপ হয়ে যায় এসএসসিতে। এমনই খারাপ হয় যে, আমি ফেল করি। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেয়ার আগে বাবা তার এক মেধাবী ছাত্রকে নিয়ে আসেন আমাকে পড়াতে। নাম তার দেবাশীষ আচার্য।

: তারপর?

: এলাকায় আমার রূপের খুব সুনাম ছিল। টের পেতাম, আমাকে দেখলে সমবয়সী ছেলেদের দম বন্ধ হয়ে যেত। টের পেতাম, শিক্ষকের মেয়ে বলে কেউ কোনোদিন কিছু বলার সাহস পেত না। আমি হিংসায় জ্বলে যেতাম অন্য বান্ধবীদের দেখে। ওদের গায়ের রং আমার মতো গোলাপরাঙা নয়, আঙ্গুলগুলোও নয় পাপড়িসদৃশ, অথচ ওরা প্রেম করে বেড়ায়, আর আমি সঙ্গিহীন। আমি কেবল ওদের প্রেমের গল্প শুনি আর হতাশ হই। দেবাশীষকে কাছে পেয়ে যেন আমার মধ্যে আশা সঞ্চারিত হলো। বই-খাতা নেয়ার ছলে ছুঁয়ে দিতাম ওর হাত। প্রথম প্রথম সে অস্বস্তি বোধ করতো। তারপর দেখি, সেও ছুঁয়ে দেয় আমাকে। একদিন আবিষ্কার করি, টেবিলের নিচে দুজনের পা আছে জড়াজড়ি করে। সেই বছর পড়াশোনা হলো ঘোড়ার ডিম, প্রেম হলো ষোলো আনা।

: তাহলে পরীক্ষা?

: দ্বিতীয়বারের মতো ফেল করলাম। বাবা গেলেন রেগে। শুরু করলো পাত্র খোঁজা, আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য। কিভাবে যেন পেয়েও গেল পাত্র। যেনতেন নয়, বিসিএস কর্মকর্তা। বাবারই ছাত্র। বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে দেবাশীষের হাত ধরে পালিয়ে এলাম রাতের আঁধারে। দূরে পালিয়ে যাওয়ার আশায় উঠলাম বরিশালের লঞ্চে। তারপর যথারীতি ডুবে গেলাম অতলে। আমি এবং দেবাশীষ দুজনই হলাম অজ্ঞাত পরিচয়ধারী লাশ।

: দেবাশীষও তোমার বাবার ছাত্র ছিল। তোমার বাবাকে তোমাদের সম্পর্কের কথা বলতে পারতে। দেবাশীষ তো ছাত্র হিসেবেও ভালো ছিল। তোমাদের বিয়েতে হয়তো তোমার বাবা-মা একমতও হতেন।

: আমাদের প্রেমের বড় প্রতিবন্ধকতা দেবাশীষের অবস্থান কিংবা ক্যারিয়ার নয়; মূল প্রতিবন্ধকতা আমাদের ধর্ম। ও হিন্দু আর আমি মুসলমান।

সালেহীন টের পায়, তার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে। টের পায়, সে যেন এক অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। কারণ, তারও প্রেমিকার নাম শুভ্রা ভট্টাচার্য। শুভ্রা হিন্দু, সালেকীন মুসলমান। ওদের দু’জনের প্রেম চলছে দুই বছর যাবৎ। সালেহীন ভাবতে থাকে, তাদের পরিণতিও কি তাহলে ফারজানা আর দেবাশীষের মতো হবে? অথচ সালেহীন আর শুভ্রা প্রেমের এমন এক বিন্দুতে আছে, যেখান থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য কারো সঙ্গে জুটিবদ্ধ হওয়া মানে ফারজানাসদৃশ কঙ্কালরূপ লাভ করা। তাদের ব্রেকআপ হলে অন্য কারো সঙ্গে যদি জোটবদ্ধ হতেই হয়, তাহলে সেখানে থাকবে নিষ্প্রাণ সংসারের এক কঙ্কাল কাঠামো।

ক্রিং..ক্রিং..ক্রিং..

সালেকীনের মোবাইল ফোনে বেজে ওঠে অ্যানালগ ফোনের মিউজিক। ফোন করেছে শুভ্রা। মোবাইল ফোনসেটের স্ক্রিনে ভাসে ‘জান কলিং’। সালেকীন ইচ্ছা করে কিছুক্ষণ শোনে রিংটোনটি। সঙ্গে সঙ্গে ধওে না শুভ্রার ফোন। শুনতেই থাকে রিংটোন। এখন আর বিরক্ত লাগছে না রিংটোনটি। দ্বিতীয়বার কল করে শুভ্রা। এবার ফোন রিসিভ করে সালেকীন।

: কী ব্যাপার? সারাদিন একটা ফোন পর্যন্ত করোনি, ঘটনা কী?

: ঘটনা আর কী? তুমিও তো একটা ফোন করলে পারতে।

: আমার যে ফাইনাল এক্সাম, সেটা তুমি ভুলে গেছ?

: ও। তাই তো। আজ তো তোমার পরীক্ষা ছিল। স্যরি, স্যরি। আসলে আমি একদমই ভুলে গিয়েছিলাম।

: হয়েছে থাক। আজ আমার পরীক্ষার কথা ভুলে যাও, ক’দিন পর আমাকেও ভুলে যাবে।

: বললাম তো বাবা, স্যরি-স্যরি-স্যরি। এখন বলো, পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

: পরীক্ষা শেষ করে তোমার মেসে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, দরোজা খোলা। ভাবলাম, তুমি হয়তো আশপাশে আছো, হয়তো ফিরে আসবে তাড়াতাড়ি। এলে না। দরোজা খোলা রেখে কোথায় গিয়েছিলে বলো তো?

: তুমি এসেছিলে মেসে?

: সে কী! রুম দেখে বুঝতে পারোনি। তোমার রুমটা কে গুছিয়ে রেখে এসেছে তাহলে?

: ও তুমিই তাহলে রুম গুছিয়েছো?

: তা নয়তো কে? তোমার ওই কঙ্কাল বন্ধু? ভালো কথা, তুমি যে একটা কঙ্কাল কিনেছো, সেটাও তো বলোনি আমাকে।

: তোমার সঙ্গে তো এরপর আর দেখাও হয়নি আমার।

: শোনো। তুমি কঙ্কালটাকে টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছিলে। আমি ওকে দেয়ালে টানিয়ে রেখে এসেছি। ওকে ওখানেই রাখবে।

: আচ্ছা।

: সালেকীন ফোন রাখো। মা ফোন করছে বার বার। কল ওয়েটিংয়ে আছে। আমি পরে তোমাকে ফোন করছি।

: ঠিক আছে।

সালেকীন ফোন রেখে ভাবতে বসে। ভাবতে বসে, কঙ্কাল ফারজানার কাছ থেকে শোনা সবকিছুই কি তাহলে ওর দুর্বল মনের কল্পনা? পুরোটাই মিথ্যা? তাকিয়ে দেখে, বিরিয়ানির প্যাকেটটা খালি। কে খেয়েছে তাহলে সালেকীনের আনা বিরিয়ানি? সালেকীন নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকায় ফারজানার দিকে। কঙ্কালটি বলেÑ

: আমি খেয়েছি বিরিয়ানি। তুমি তো আমার জন্যই এনেছিলে, নাকি?

: হ্যাঁ। তোমারই তো খাওয়ার কথা।

: তুমি সম্ভবত আমার অস্তিত্বকে আর বিশ্বাস করতে চাইছো না।

সালেকীন বুঝতে পারে, ফারজানার হঠাৎ মন খারাপ হয়েছে কোনো কারণে। সে ফারজানাকে সান্তনা দেবে বলে ওর হাত ধরে। টের পায়, একমাত্র দেবাশীষ ছাড়া আর সব হাতের স্পর্শই ওর কাছে অনান্তরিক এবং যন্ত্রবৎ।

লেখক : নাট্যকার

পিডিএসও/ শহীদ রানা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কঙ্কাল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist