মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ
ভূতো দাদুর গল্পের আসর
সরলপুর গ্রামের শিকদারবাড়ি। এই বাড়ির পুকুরপাড়ে বিশাল এক তেঁতুল গাছ। তেঁতুল গাছ ঘন ঘন ডালপালা আর চিকন পাতায় ভরা। যে কারণে দুপুর বেলাও তেঁতুল গাছ গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে থাকে। এই তেঁতুল গাছে চারটি ভূত বাস করে। একটি ভূত খুনখুনে বুড়ো। তার আসল নাম ভূতো। কিন্তু চমৎকার সব গল্প জানে বলে সবাই তাকে ‘গল্প দাদু’ বলে ডাকে। গল্প দাদু অনেক গল্প জানে। হরেক রকম গল্প। অনেক ধাঁধা জানে। চুইংগামের সঙ্গে পান মিশিয়ে খেতে খেতে সে গল্প বলে। বাচ্চাদের নতুন নতুন ধাঁধা ধরে।
বাকি তিনটি বাচ্চা ভূত। বাচ্চা ভূতগুলোর নাম হাতু, মিতু ও ভাতু। হাতু সারাক্ষণ এর-ওর গায়ে হাত দিয়ে বিরক্ত করে বলে তার নাম হাতু। মিতু সকাল-বিকাল মিষ্টি খায়। তাই ওর নাম মিতু। মিতু কিন্তু মেয়ে ভূত! আর ভাতু ভাত ছাড়া কিছু বোঝে না। সারাদিন শুধু ভাত খায়। তাই ওর নাম ভাতু। গল্প দাদু হাতু, মিতু ভাতুর দাদু হয়। ওদের বাবা-মা নেই। তাই দাদুর সঙ্গে থাকে।
সন্ধ্যায় বেলায় গল্পের আসর বসেছে। মিতু আজ দুই হাতে দুটি কালোজাম নিয়ে এসেছে। কালোজাম মিতুর খুব পছন্দ। কে যেন বলেছিল, মিষ্টি খেলে বুদ্ধি হয়। সেদিন থেকে মিতু মিষ্টি খায়। তার অনেক বুদ্ধি লাগবে। কারণ, অনেক বুদ্ধি ছাড়া ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া যায় না।
কালোজামে টুক্কুস করে একটা কামড় দিয়ে মিতু বলল, ‘দাদু, আজ কী গল্প শোনাবে?’ এই কথা শুনে হাতু ও ভাতু হাতাহাতি বন্ধ করে দাদুর দিকে তাকাল। দাদু হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘আজ তোমাদের একজন ছড়াকারের গল্প শোনাব।’ হাতু বলল, ‘দাদু, ছড়াকার কাকে বলে?’ দাদু মুখ থেকে পান ফেলে বাতাস দিয়ে কুলকুচি করে ইয়া বড় একটা চুইংগাম মুখে দিয়ে বলল, ‘বলব। সবই বলব। তোমরা মন দিয়ে শুনবে, ঠিক আছে?’
হাতু, মিতু, ভাতু তো জানেই বড়দের গল্প শোনার সময় কথা বলতে হয় না। তাই তারা একসঙ্গে বলল, ‘ঠিক আছে দাদু, আমরা কোনো কথা বলব না।’
দাদু বললেন, ‘যিনি ছড়া লেখেন তাঁকে ছড়াকার বলে। আজ যে ছড়াকারের গল্প বলব তাঁর নাম সুকুমার বড়–য়া।’ হাতু মিতু আর ভাতু ছড়া পড়তে ভীষণ পছন্দ করে। ছড়ার কথা শুনে ওদের চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল।
দাদু তার তিন নাতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো তো আমি কেন ‘তার’ শব্দটায় চন্দ্রবিন্দু দিয়ে নাকের ভেতর নিয়ে উচ্চারণ করছি?’ হাতু মিতুর পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘আমি পারব না। তুমি বলে দাও।’ মিতু মাথা চুলকাতে লাগল। কিন্তু বলতে পারল না। ভাতু ডানে-বায়ে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল সেও পারবে না। দাদু বলল, ‘তাহলে আমাকে প্রশ্ন করলে না কেন? যেটা বুঝবে না সেটা প্রশ্ন না করলে তো কোনো দিন জানা হবে না, তাই না? জানার জন্য প্রশ্ন করতে হয়।’
দাদু চুইংগাম আর পান একসঙ্গে খায়। চুইংগাম মুখে রেখেই আরেকটা পান মুখে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘কোন সম্মানিত ব্যক্তির লেখা এবং উচ্চারণের সময়, তাঁর, যাঁর, তাঁকে, যাঁকে.. এই ধরনের শব্দগুলোয় চন্দ্রবিন্দু দিয়ে লিখতে ও উচ্চারণ করতে হয়। বুঝলে?’
সবাই একসঙ্গে মাথা কাত করে জানিয়ে দিল, তারা বুঝেছে। দাদু পোকায় খাওয়া দুই দাঁতের ফাঁক দিয়ে লাল টকটকে পিক ফেলে বলল, ‘চলো মূল গল্পে চলে যাই। ছড়াকার সুকুমার বড়–য়া ১৯৩৮ সালের ৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন।’
এমন সময় ভাতু বলে উঠল, ‘তার মানে উনার হ্যাপি বার্থ ডে ৫ জানুয়ারি?’ ভাতুর কথা শুনে হিহিহিহি হাহাহাহা হাসির রোল পড়ে গেল। দাদু সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, হ্যাঁ। ৫ জানুয়ারি সুকুমার বড়–য়ার হ্যাপি বার্থ ডে। তাঁর জন্ম হয়েছিল চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম সর্বানন্দ বড়–য়া এবং মায়ের নাম কিরণ বালা বড়ুয়া।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই ছড়াকার কিন্তু অনেক গরিব ঘরের সন্তান। তিনি পড়াশোনা করেছেন মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। এ সময় হাতু বলে উঠল, ‘তার মানে ক্লাস টু পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন?’ গল্প দাদু বলল, ‘হ্যাঁ দাদুভাই। উনি মাত্র ক্লাস টু পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তিনি ছিলেন অনেক মেধাবী। পড়ালেখা করতে না পারলেও দারুণ দারুণ সব ছড়া লিখেছেন। তাঁর একটা ছড়া শুনবে?’ হাতু, মিতু ও ভাতু একসঙ্গে বলল, ‘তোমার মুখস্থ আছে? তাহলে শোনাও।’
দাদু ছড়া আবৃত্তি শুরু করলÑ
‘রাশবিহারি দাশের নাতি
হাসপাতালে বাস করে,
মাস ফুরোলে দেশে গিয়ে
খাসজমিতে চাষ করে।
পাস করেনি পরীক্ষাতে
পয়সাকড়ি নাশ করে,
হাতের কাছে কাউকে পেলে
চড় মেরে দেয় ঠাস করে!’
শেষ লাইন বলার সঙ্গে সঙ্গেই হাতু ভাতুর গালে চড় মারতে গেল। মিতু হিহিহিহি করে হেসে উঠল। ভাতু বলল, ‘ওয়াও! খুবই সুন্দর ছড়া তো। উনি সত্যিই সুন্দর লিখতেন।’
দাদু বলল, ‘তবে আর বলছি কী? আমাদের এই ছড়াকার কিন্তু ছোটবেলায় মাকে হারান। বাবাও নিখোঁজ হন কিছুদিন পর। পড়াশোনা করতে পারেননি। তার পরও সুকুমার বড়–য়া থেমে থাকেননি। খুব ছোট একটা চাকরি করেছেন। চাকরি ছোট হলে কী হবে? সুকুমার বড়–য়ার মনটা আকাশের মতো বড়। যেই কারণে তার ছড়াগুলো রোদের মতো ঝকঝকে।
লেজ আবিষ্কার, ছোটদের হাট, ঠিক আছে ঠিক আছে, নদীর খেলা, ঠুসঠাস, ভিজে বেড়াল, পাগলা ঘোড়া, চিচিং ফাঁকসহ তিনি বিশটির বেশি বই লিখেছেন।
ছোট পেশার বড় মানুষটি বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের কারণে পেয়েছেন ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’, ‘অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার’, ‘শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘আনন ফাউন্ডেশন আজীবন সম্মাননা’, ‘নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার।’
দাদু দেখল সবাই হাঁ করে তার গল্প শুনছে। যেন তারা ভাবছে, জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো। দাদু বলল, ‘সুকুমার বড়–য়ার আরেকটা ছড়া তোমরা শুনবে?’ সবাই একসঙ্গে বলল, ‘হ্যাঁ দাদু। শুনব।’
দাদু ছড়া আবৃত্তি শুরু করলÑ
অসময়ে মেহমান
ঘরে ঢুকে বসে যান।
বোঝালাম ঝামেলার
যতগুলো দিক আছে,
তিনি হেসে বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
রেশনের পচা চাল
টলটলে বাসি ডাল
থালাটাও ভাঙাচোরা
বাটিটাও লিক আছে,
খেতে বসে জানালেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
মেঘ দেখে মেহমান
চাইলেন ছাতা খান
দেখালাম ছাতাটার
শুধু কটা শিক আছে
তবু তিনি বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
আবার সবাই হিহিহিহি করে হাসতে শুরু করেছে। এমন সময় দাদু ঠোঁটে আঙুল নিয়ে থামতে বলল। ‘হিশশশ, ওই দেখ দুজন মানুষ টেঁটা নিয়ে পুকুরে মাছ ধরতে আসছে। রাতের বেলা মাছ পুকুরের পারে চলে আসে। এরা টর্চ জ্বেলে সেই মাছের গায়ে টেঁটা মারে। টেঁটার শক্ত চিকন আর ধাঁরালো শিকে মাছ গেঁথে যায়। চল আজ আমরা মানুষদের মাছ ধরা দেখব।’
হাতু এমনিতে দুষ্টু। কিন্তু সে মানুষ দেখলে ভয় পায়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দাদুকে বলল, ‘না দাদু। আমি মাছ ধরা দেখব না। আমার ভয় করছে। চলো আমরা চলে যাই।’ দাদু বলল, ‘ঠিক আছে চলো আমরা এই তেঁতুল গাছের একেবারে মগডালে গিয়ে লুকাই। আর যাওয়ার সময় ছড়াকার সুকুমার বড়–য়ার একটা ছড়া পড়তে পড়তে যাই।’ বলে দাদু মিছিলের মতো করে ছড়া বলা শুরু করলে মিতু, হাতু আর ভাতুও দাদুর সঙ্গে মিছিলের মতো করে সুকুমার বড়ুয়ার ছড়া পড়তে শুরু করল।
ক-শাখা, খ-শাখা
গ-শাখা, ঘ-শাখা
দুপুরের ছুটিতে
নুন দিয়ে শসা খা
পরীক্ষায় ফেল হলে
হাঁ করে মশা খা।
"