কাইয়ুম আহমেদ

  ১৪ এপ্রিল, ২০২০

হায় করোনা, হায় বৈশাখ

‘কী গাব আমি, কী শুনাব, আজি আনন্দধামে’? কবিগুরুর এই গান আজ হয়ত গাইছে সবাই। আজ পহেলা বৈশাখ, চৈত্রসংক্রান্তির মাধ্যমে আজ ১৪২৬ সনকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হলো নতুন বছর ১৪২৭। জীর্ণ-পুরাতনকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করল বাঙালি জাতি। কিন্তু চৈত্রের রুদ্র দিনের শেষে বাংলার ঘরে ঘরে যে উৎসবের প্রস্তুতি তাতে ‘বাড়া ভাতে ছাই’ দিয়েছে প্রাণঘাতী কোভিড-১৯।

অপেক্ষায় ছিল রমনার বটমূল। মঙ্গল শোভাযাত্রার পেছনে শ্রম আর ঘাম দিচ্ছিলেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোর ম্যানিকুইনরাও সেজেছিল বৈশাখি পোশাকে। তরুণ-তরুণীরা কী পরবে তারও আয়োজন ছিল তাদের মনে। কিন্তু কোভিড-১৯ এর হানায় থমকে গেছে সব। সরকারি নির্দেশনা মেনে ঘরবন্দি মানুষ। বাইরে বেরোনো মানা।

তবু ‘ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে/দীপ্ত নীলে, শুভ্র রাগে/প্রভাত রবি উঠল জেগে/দিব্য পরশ পেয়ে/নাই গগনে মেঘের ছায়া/যেন স্বচ্ছ স্বর্গকায়া/ভুবন ভরা মুক্ত মায়া/মুগ্ধ হৃদয় চেয়ে। ...বাংলা নতুন বর্ষকে এভাবেই আবাহন করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। বাঙালির জীবনে আজকের সোনালি ভোরের সূর্য নিয়ে এসেছে নতুন বার্তা। এই বার্তা সবার জীবনে বয়ে আনুক শান্তি-সুখের দিন। জরা, শোককে মুছে বাংলা বছর নতুন প্রত্যশা আর উদ্দীপনা নিয়ে শুরু হোক। আজ কালবৈশাখি এসে করোনাভাইরাসকে পৃথিবীকে থেকে ধুয়ে-মুছে নিয়ে যাক— এবারের নতুন বছরের প্রথম দিন এমন প্রত্যাশা যেন সবারই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাতেও সেই সুর। তিনি বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী রীতিতে নববর্ষ উদ্?যাপন বন্ধ থাকলেও ডিজিটাল পদ্ধতিতে গান-বাজনা-উৎসব সবাই করতে পারেন।’ ঘরেই বসুক বৈশাখি আসর। বৈশাখি সাজ আর ইলিশ-পান্তার সঙ্গে বাহারি ভর্তা যোগে যাপন হোক পহেলা বৈশাখ।’

নভেল করোনাভাইরাস মহামারি আকার নেওয়ায় এ বছর চৈত্রসংক্রান্তি হয়নি। হচ্ছে না নববর্ষ উদ্যাপন। এ নিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে খেদ থাকলেও ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সবাই বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছেন। এবার হচ্ছে না বর্ষবরণ।

গ্রামের সরলজন কিংবা নগরমানুষ পুরনো অসত্য, অসুন্দরকে ফেলে এগিয়ে যাবে চৈত্রসংক্রান্তির মহাক্ষণে। কথা ছিলÑ মেলা, পুুতুল নাচ, চড়ক-গাজন উৎসবে মাতবে বাঙালি। হালখাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথাও ছিল ব্যবসায়ীদের।

প্রাণঘাতী নভেল কোভিড-১৯। না এবার হাতে থাকছে না হাত। কাঁধ মিলছে না কাঁধে। সত্য-সুন্দরের আগমনের কোনো সুরও বাজছে না। তবে কি বাঙালি সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা থেমে যাবে?

সংস্কৃতি দিয়েই তো বাঙালি কত কিছুর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করল। জয়ী হলো। তবে এবার শত্রু অদৃশ্য হলেও তার পদচ্ছাপ, তার বিস্তার দৃশ্যমান বিশ্বজুড়ে।

প্রায় ১৯৬১ সালে যাত্রা শুরু করা ছায়ানট ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতি বছর রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের ভোরে বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে আসছে। এর আগে মাত্র একবার মুক্তিযুদ্ধকালে অনুষ্ঠানটি হয়নি। এবার দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠানটি বাতিল করা হয়েছে।

বাংলা বর্ষবরণের আরেক ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া এ অনুষ্ঠানকে জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ অনুষ্ঠানও এবার বাতিল করা হয়েছে। তবে রীতি অনুসারে প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলা বর্ষবরণের পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছে। এটি ভার্চুয়ালি প্রকাশিত হয়েছে। আজ সকালে আবারও নতুন সূর্য উঠল। রক্তিম আভা ছড়িয়ে চারপাশ আলোকিত করল।

অঞ্জন’সের স্বত্বাধিকারী শাহিন আহমেদ বলেন, বৈশাখের আনন্দ মূলত ঘুরে বেড়ানোতেই। করোনার কারণে সবাই ঘরবন্দি। তবু পহেলা বৈশাখের দিনটা এই আতঙ্কের সময়েও একটু খুশির আমেজে বাসাতেই যাপন করা যেতে পারে। নতুন পোশাক এবার কিনতে না পারলেও আগের বছরের পোশাকটি পরে ফেলুন। সকালে পান্তা ভাত ও ভর্তা তৈরিতে পরিবারের সবাই একে অন্যকে সাহায্য করুন। গল্প করুন। টেলিভিশনে বৈশাখি অনুষ্ঠান দেখতে বসে যান। গত বৈশাখের গল্প করেও সময় কাটাতে পারেন।

ফ্যাশন হাউস নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান বলেন, এখন ভিন্ন সময়। বিদ্যমান পরিস্থিতি মেনে নিয়েই দিনটা পালন করা উচিত। ইলিশ-পান্তার মতো আভিজাত্যের দিকে না গিয়ে বরং সবাইকে সহযোগিতার মধ্যেই বৈশাখের আনন্দ খুঁজে নিন। এদিন আমরা একে অন্যের বাসায় ঘুরতে যেতাম। এবার সেটা সম্ভব নয়। এজন্য মোবাইলে সবার খোঁজ-খবর নিন। ফোনে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান। ভিডিও কল দিয়ে সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারেন। গ্রুপ ভিডিও কলে একসঙ্গে অনেককে যুক্ত করা যায়। সবাই মিলে আড্ডা দিন। দেখবেন ঘরেও নববর্ষ মন্দ কাটছে না। ছেলেমেয়েদেরও তাদের বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে বা ফেসবুকে ভিডিও কলে সংযুক্ত করে দিতে পারেন।

ফ্যাশন হাউস রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাস বলেন, ‘আগামী বছরের বৈশাখ যাতে সবার সঙ্গে মিলেমিশে যাপন করতে পারি এজন্য এখন ঘরে থাকা জরুরি। এজন্য ঘরেই ছোট্ট পরিসরে বৈশাখি আয়োজন করতে পারেন। রান্নার কাজটা সবাই মিলে করলে সকালের সময়টা সুন্দর কাটবে। রান্না হয়ে গেলে পরিবারের ছোটদের গোসল করিয়ে বৈশাখি পোশাক পরিয়ে দিন। কেনাকাটা করতে পারেননি তাতে কী। গত বছরের পোশাকেই সাজুক ছোটরা। একসঙ্গে খেতে বসুন। বিকালে ছাদে গল্পের আসর বসাতে পারেন। সেখানে পরিবারের সবাইকে নিয়ে গান-গল্প-আড্ডায় মেতে উঠতে পারেন।

রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বলেন, এবার পহেলা বৈশাখে পার্লারে আসার দরকার নেই। বরং ঘরেই একে অন্যকে সাজিয়ে দিন। ছোটদের আনন্দ বেশি। তাদের বৈশাখি সাজে সাজিয়ে দিন। নিজেরাও ভালো কাপড় পরে নিন। শুধু সাজলেই হবে না। ঘোরাঘুরির সুযোগ নেই তাতে কী। নিজেদের ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করুন। সবার সঙ্গে ভিডিও কলে আড্ডা দিন। এদিন ডাইনিং টেবিলটাও সাজিয়ে নিন বৈশাখি ঢঙে। মাটির থালাবাসন থাকলে সবচেয়ে ভালো। সবাই মিলে বৈশাখি ঢঙে পুরো বাসা সাজিয়ে ফেলুন। এমন আয়োজন কয়েক দিনের একঘেয়ে জীবনে ভিন্নতা আনবে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বৈশাখ,করোনা,বাংলা নববর্ষ,বাংলা নববর্ষ উদযাপন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close